ঘ্রাণ

Printed Edition
ঘ্রাণ
ঘ্রাণ

উম্মুল খায়ের

মনে হচ্ছে হাজার হাজার পিন আমার শরীরের ভেতরে ঢুকে আছে। ব্যথায় টনটনে অবস্থা। চোখ খোলার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।দুনিয়ার সমস্ত ঘুম যেন লেপ্টে আছে দুচোখের পাতায়।এমন সময় একটা ঘ্রাণ এসে লাগল আমার নাকে। অতি পরিচিত মানুষের ঘ্রাণ। কিন্তু কে সে, সেটা মনে করতে পারছি না। সুইডিশ গবেষকদের মতে, মানুষের শরীরের ঘ্রাণে জড়িয়ে আছে মানুষের আবেগ, অনুভূতি আর ভালোবাসা। এইতো দুই বছর আগে তাদের গবেষণার প্রতিবেদন পড়ছিলাম। সেখান থেকেই জেনেছি, মানুষের শরীরের ঘ্রাণ তিন স্তর বিশিষ্ট হয়ে থাকে। প্রথম স্তরে গোসল ও পারফিউম, দ্বিতীয় স্তরে খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশ আর তৃতীয় স্তরের ঘ্রাণ আসে মানষিক গঠনের ওপর। তৃতীয় স্তরের এই ঘ্রাণই স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। যা কখনোই কারো সাথে মেলে না। মানব শিশু জন্ম থেকেই প্রাকৃতিকভাবে মানুষের শরীরের ঘ্রাণ নেয়ার শক্তি অর্জন করে। ফলে এই ঘ্রাণ শক্তি দিয়েই সে তার মাকে সহজে চিনে নিতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি তো চিনতে পারছি না। চোখ মেলে তাকালে হয়তো চিনতে পারতাম। কিন্তু কে যেন সুপার গ্লু দিয়ে আমার চোখের পাতা আটকে দিয়েছে!

আহা, আমি কি পাগল হয়ে গেছি! কি সব ভাবছি! আমার চোখ বন্ধ, হাত-পা অবশ, তবুও একটি পরিচিত পরিচিত ঘ্রাণ অস্থির করে তুলেছে! উহ! এত ভালো লাগছে কেন এই ঘ্রাণটা! কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি গবেষণায় জানা গেছে, প্রিয়জনের গায়ের ঘ্রাণ বড়দের চোখে আরামের ঘুম আনতে সাহায্য করে। তবে কি আমি ঘুমিয়ে আছি আরামে? নাকি মরে গেছি? মরে গেলে কি মানুষ প্রিয়জনের গায়ের ঘ্রাণ পায়? ইসলামিক স্কলার কাউকে পেলে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

কেউ একজন পরম মমতায় আমার গাল ছুঁয়ে হালকা গলায় দরদ মিশিয়ে ডাকছে, লিপি! এই লিপি! চোখ খোল তো!

শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে আমার চোখ খোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে হচ্ছে, আস্ত দুটো তার্জিংডং পর্বতশৃঙ্গ দুচোখের উপরে বসে আছে! সেই কণ্ঠস্বর আবারো বলে উঠল, লিপি! এই লিপি! সাড়া দে প্লিজ ।

আমি হাত উঠাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু হাত-পা তো পাথর হয়ে গেছে! এক বিন্দু শক্তি নেই। সমস্ত শরীর যেন আস্ত পাথর কিন্তু হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে! কিশোরী বয়সে ঠিক এই রকম কণ্ঠের আওয়াজে আমার মনে শিহরণ বয়ে যেত। হৃদয় নেচে উঠত তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ করে। আহা! কি যে মধুর লাগত সেই সময়টা! প্রতিটি বিকেল কাটত আনন্দে। সবাই বাইরে খেলত আর আমি বারান্দার গ্রিল ধরে বসে থাকতাম। আমাদের বাবা-মা বাইরে যেতে দিতেন না। মা বলতেন, বড় হচ্ছ এখন দৌড়ঝাঁপ করা ঠিক না, ছেলেদের সাথে খেলা করবে না, কারো সাথে ঝগড়া করবে না, আরো আরো কত যে শাসন!

কত যে বারণ!

প্রথম যেদিন ঋতুবতী হই সেদিন মা অনেক কিছু শেখালেন। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে কি খাব, কি কি খাব না, কিভাবে শরীরের যতœ নেবো, স্যানিটারি ন্যাপকিন কিভাবে কাগজে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে, এ সব আর কি! তবে সবশেষে বললেন, এখন থেকে ছেলে বা পুরুষদের থেকে দূরে থাকবে। ওরা তোমাকে ছুঁয়ে দিলে কিন্তু তোমার পেটে বাচ্চা চলে আসবে। মায়ের এই কথা শুনে ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, স্কুল বন্ধ ছিল। খুব মনে পড়ে, রোজার ছুটিতে ছিলাম, ঠিক তখনই প্রথম ঋতুবতী হই। ঈদের দিন সকালে প্রিয় কণ্ঠস্বরের মানুষটি এলো আমাদের বাসায়। বলেই ফেলি, তার নাম বাবু। বাবু ভাই তখন কলেজে পড়তেন, আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। আম্মা বাবু ভাইকে খেতে দিলেন। ঈদের দিনে বাসায় তো অনেক রকম আইটেম রান্না করতেন আম্মা। বাবু ভাই সবগুলো আইটেম একটু একটু করে খেলেন। খাওয়া শেষে কি কারণে যেন তিনি আমার হাত ধরলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না শুরু করে দিলাম। আম্মা গো! বাবু ভাই আমার হাত ধরেছে,এখন তো আমার পেটে বাচ্চা চলে আসবে। আমার কি হবে? আ-ম-ম্মা...

বাবু ভাই আমার মুখ চেপে ধরলেন। এই চুপ! চুপ! এসব কি কথা! বাচ্চা চলে আসবে মানে কি?

আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বাবু ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করি। বাবু ভাই আমার মুখ ছেড়ে দিলেন। চোখ লাল করে বললেন, কি বলিস এসব?

আপনি আমাকে ছুঁয়ে দিলেন কেন?

তুই কথা শুনিস না কেন? তাই তো তোর হাত ধরেছি।

সে জন্যই তো আমার পেটে বাচ্চা চলে আসবে।

কে বলেছে এই কথা?

আম্মা বলেছেন।

কি!

হুম। আম্মা বলেছেন, ছেলেরা ছুঁয়ে দিলে মেয়েদের পেটে বাচ্চা চলে আসে। তাই তো আমি এখন আর বাইরে বের হই না।

হি হি হি হি।

বাবু ভাই শব্দ করে হেসে উঠলেন, আর বললেন, তুই একটা মহা গাধি। এই তোর বুদ্ধি হবে কবে রে? এসব কথা আর কাউকে বলবি না।

এমন সময় ডাইনিং রুমে আম্মা চলে এলেন। বাবু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি হয়েছে বাবা? বাবু ভাই বললেন, কিছু না খালাম্মা।

এত বছর পরে সেই বাবু ভাইয়ের কণ্ঠস্বর! হৃৎপিণ্ডের ভেতরে কেমন যেন তাতা থৈ থৈ তাতা থৈথৈ শব্দ করছে! ৩৫ বছর পরে প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। সত্যি বলছি, আরাম লাগছে। অন্য রকম একটি অনুভূতি হচ্ছে মনের মধ্যে। যেন বুঁদ বুঁদ উঠছে হৃদয়ের ভেতর থেকে! হ্যাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি সব কিছু। বাবু ভাইয়ের সাথে আমার একমাত্র ছেলে মাসুক কথা বলছে। মাসুকের কণ্ঠে কেমন যেন জড়তা আর কষ্টের ঢেউ ঝুলে আছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে মাসুক বলছে, মা সুস্থ হবেন তো? স্যার?

আল্লাহ মালিক। আশা করা যায়। আচ্ছা মাসুক, লিপি মানে তোমার মা কেন আন্দোলনে গেলেন?

জানি না স্যার।

তুমি মেডিক্যাল কলেজে পড়েছ আর সে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে আন্দোলন করতে! চিরকাল সে গাধি থেকে গেল! বুদ্ধি হলো না ।

বাবু ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। তাকে বলতে ইচ্ছে করছে, ওরে বোকা ছেলে! মায়েরা যদি ছেলে-মেয়েদের সাহায্য-সহযোগিতা না করে, তাহলে কি তাদের বিজয় আসবে? আমি গাধি না। তুমি বোকা। মহা বোকা।

কিন্তু কথা বলতে পারছি না। আমার মগজের মধ্যে কেমন যেন ঝিমঝিম অবস্থা হয়ে আছে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমি যেন মাটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছি। গভীর একটি গর্ত; ঘন অন্ধকারে ডোবা। সেখানে যেন সাঁই সাঁই করে নেমে যাচ্ছি আর নেমে যাচ্ছি। অনেকটা লিফটে করে যেভাবে নামা হয় ঠিক যেন সেভাবেই তলিয়ে যাচ্ছি নিচে আরো নিচে। গভীরতম নিচে!

বাবু ভাই আমার হাত ছুঁয়ে দিলেন। কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, লিপি তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবি, ইনশাআল্লাহ। অনেক কথা আছে তোর সাথে। ভালো থাক। প্রতিদিন তোকে দেখতে আসব। খোদা হাফেজ। আজকের মতো খোদা হাফেজ।

আমার নাকের পাতা কেঁপে উঠছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, তোমার সাথে আমার কোনো কথা নাই। তুমি একটা বোকা। বোকার সাথে কিসের কথা?

এ সময় আমার কলিজার টুকরো মাসুক আমার কাছে এসে কপালে চুমু দিলো আলতো করে। কী যে আনন্দের স্পর্শ! কি যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে সন্তানের ছোঁয়ায়! সেটি বলে বোঝানো যাবে না। আমার ডাক্তারের ছেলের ছোঁয়া! আহা! আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। আমার চোখের পানি দেখে, মাসুক চিৎকার করে বলে, স্যার মা কাঁদছেন। বলতে বলতেই মাসুক শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। বাবু ভাই বললেন, তাই? আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।

আমি বুঝতে পারছি, ডাক্তার শফিকুর রহমান বাবু তার প্রিয় ছাত্র মাসুককে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, Masuk,you are a doctor. You must control your emotions, my dear.

মাসুক চোখ মুছে বলল,sorry sir.I’m really trying but after all She’s my mother.

Everything is going to be Alright. Please don’t worry at all.

You are absolutely correct, Sir. আমি আর কাঁদব না। কেন কাঁদব? I feel proud of my mother.

আমার কলিজার টুকরো মাসুক, তুমি আমার রক্তের সন্তান কিন্তু সারা দেশে আমার হাজার হাজার আত্মার সন্তান রয়েছে। চব্বিশের জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ওরা যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন আমি আর ঘরে থাকতে পারিনি। ওরা না খেয়ে সারাদিন আন্দোলন করেছে। জীবনকে তুচ্ছ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে। আমি তো মা। কি করে চুপ থাকি? ওদেরকে খাবার পানি এবং খাবার দিয়ে সাহায্য করেছি। পাশের বাড়ির রাইমা ভাবী আর আমি প্রতিদিন পানি, সিঙ্গারা, কলা, আপেল কিনে দিতাম ওদের। খুব ভালো লাগত। ভালো কাজ করলে মনের মধ্যে আনন্দ হয়। অন্যরকম একটি আনন্দ। সেই আনন্দ নিয়েই আমরা কাজ করছিলাম আর ছাত্র-ছাত্রীরা চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিল-

চাইতে এলাম অধিকার

হয়ে গেলাম রাজাকার।

তুমি কে? আমি কে?

রাজাকার। রাজাকার

কে বলেছে? কে বলেছে?

স্বৈরাচার। স্বৈরাচার।

আমিও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলাম, হঠাৎ একদল আওয়ামী পশু এসে আমাদের উপরে হামলে পড়ে। কোথা থেকে যে কী হলো কিছুই টের পাইনি! দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, তারপর পশুগুলো পাগলের মতো আমাকে পেটাতে থাকে। উফ্ কি যে ভয়ঙ্কর ছিল মুহূর্তটা!

আমার কলিজার টুকরো মাসুক, তুমি কাঁদবে না। তোমার কান্না সইতে পারি না। জীবনের সুখ, হাসি, আনন্দ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তোমাকে বড় করেছি। তোমার বাবা চলে গেছেন এক যুগ। তোমাকে আমি বাবার অভাব বুঝতে দেইনি। আমি তোমার বাবা, আবার আমিই তোমার মা। আজ তুমি ওহঃবৎহ ফড়পঃড়ৎ. হাসিমুখে মানবসেবা করবে। অর্থের পেছনে ছুটবে না। মানুষের ভালোবাসা তোমাকে অমর করে রাখবে। যদি আমি মরে যাই তবে কোনো দুঃখ নেই, কোনো আফসোস নেই। আমার একমাত্র বুকের মানিককে মানুষের সেবা করার জন্য তৈরি করতে পেরেছি। একজন বিধবা অসহায় নারী হয়ে এটি করা সত্যিই কঠিন ছিল। সেই কঠিনকে জয় করেছি। আবার হাজার হাজার বিপ্লবী সন্তানদের সাহায্য করতে পেরেছি। সত্যি বলছি, আমার কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। আমি বিশ্বাস করি, জুলাই বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান সফলতা আনবেই আনবে।

তার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি। দূরে চলে যাওয়ার শব্দ। ৩৫ বছর পরে যে ঘ্রাণ আমাকে দোলা দিয়েছে, সেই ঘ্রাণ আর পাচ্ছি না। সে চলে গেছে। He has left. Everyone must leave. এটাই হয়তো জীবন। বাবুভাই যখন কলেজে পড়তেন তখন একটি গান খুব বেশি করে গাইতেন। ফুটবল মাঠে বসে গলা ছেড়ে গাইতেন-

জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প

যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও

যা কিছু বলার নাও বলে নাও

পাবে না সময় আর হয়তো-