তীব্র তাপদাহে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশ। তাপের অসহনীয়তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দেশ। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অসহ্য গরমে সারা দেশে চলছে হাহাকার। বাদ যায়নি বনের প্রাণীও। একটু সুযোগ পেলেই পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা। স্বল্প বৃষ্টিতেও আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়া তাপ যেন নিভছে না।
ঋতু অনুযায়ী সাধারণত বারো মাসের মধ্যে এপ্রিল মাসকেই বছরের সবচেয়ে তাপদাহের মাস বলে ধরে নেয়া হয়। বিগত সময়েও তাই হয়েছে। কিন্তু সময়ের সাথে সব যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। তীব্র তাপদাহের মাস বলে এখন আর কিছু থাকছে না। সবই একাকার হয়ে যাচ্ছে। যে মাসে যা হওয়ার নয় প্রকৃতি বদলে তাই হচ্ছে। ফলে বিগত দিন বদলের সাথে তাপমাত্রাও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বিশ্বে জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। বাড়ছে দুর্যোগ। আর এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার অন্যতম হলো- জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পকারখানা থেকে অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন, জলবায়ুর ওপর সমুদ্রের প্রভাব, সবুজায়ন ধ্বংস, নদী, পুকুর খাল বিল ও জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ। এতে দিন দিন নানা ধরনের দুর্যোগের সাথে তাপমাত্রাও বাড়ছে। যা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা আগাম সঙ্কেত দিয়ে বলছে, তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে আগামী ৫০ বছরে বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা বলছে, সামনের ৫ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা মানুষের সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। যা ৪৫ থেকে ৪৬ ডিগ্রি ছাড়াবে।
অন্যদিকে পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো বলছে, গত প্রায় ৪ যুগে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আগামীতে তা দৈনিক গড় উষ্ণায়নের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে এবং শীতকালের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালের চেয়ে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে। আর আগামী ৫ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে ৪৫ ডিগ্রি ছাড়াবে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন দেশের প্রায় ২৬ জেলাতে তাপদাহ বইছে। মূলত এলনিনোর প্রভাবে সারা পৃথিবীতেই এমনটা হচ্ছে। তার মতে, এভাবে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে গাছপালাবিলীন এবং শস্য আবাদে চরম ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই এর সমাধানে ভূপৃষ্ঠে পানির রিজার্ভার বাড়াতে খাল, পুকুর খনন ও সংস্কার ও সবুজায়ন বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, জলবায়ু প্রভাবে ভয়াবহ বন্যার সাথে তাপমাত্রা বাড়ছে। তিনি বলেন, দেশে সবুজায়ন ধ্বংস, জলাশয় ও খালি জায়গা বাণিজ্যকরণের কারণে তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এটি বন্ধ না হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
অন্যদিকে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের চেয়ারপারসন ও সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, যদি তাপদাহের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তবে ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আমাদের জন্য অসহনীয় হবে। এর নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উপায় গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো। যার মাধ্যমে তাপপ্রবাহ কমবে।
উত্তরের তাপদাহে অতিষ্ঠ ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানুষ : বাসস জানায়, টানা ১০ দিনের ঈদের ছুটি কাটাতে নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন অনেকে। কিন্তু ঈদের ছুটির সাথে সাথে দেশের উত্তরের জনপদে চলছে তাপদাহ। তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষেরা। না তারা ঘরে স্বস্তি পাচ্ছেন। না তারা বাইরে বেরুতে পারছেন। প্রচণ্ড গরমে আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করার কথা ভাবতেও পারছেন না।
ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জান্নাত জ্যোতি। ঈদুল আজহার দুই দিন আগে ৮ ঘণ্টার রাস্তা ২২ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে রংপুর নগরীর শাহীপাড়ায় নিজ বাড়িতে এসেছেন। ভেবেছিলেন ঈদের ছুটি ভালোভাবে কাটিয়ে চাকরিতে যোগ দেবেন। কিন্তু তার ঈদ উদযাপনের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ড তাপদাহ।
মাহফুজা শারমিনও ঈদ করতে এসেছেন ৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে। গরমের কারণে কোথাও বের হতে পারেননি। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দুই দিন ধরে তার মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত। তাদের মতো অনেকেই ঈদ উদযাপন করতে এসে তাপদাহের কারণে বিপাকে পড়েছেন। গরমের কারণে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারছেন না।
গত কয়েক দিন ধরেই রংপুর এবং এর আশপাশের এলাকায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। তপ্ত আবহাওয়ার কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি ঈদে বাড়ি আসা মানুষ। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথেও দেখা করতে যাননি। এক প্রকার ঘরবন্দী অবস্থায় দিন কাটছে তাদের।
আবহাওয়া অফিস জানায়, রংপুর ও আশপাশের এলাকায় কয়েক দিন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। আকাশে মেঘের কোনো ছিটাফোঁটা নেই। সূর্যের কিরণ সরাসরি ভূপৃষ্ঠের ওপর পড়ায় ভূপৃষ্ঠ খুব তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
এ দিকে প্রচণ্ড গরমের কারণে প্রায় ঘরেই জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিয়েছে। প্রাণী জগতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গরু, হাস-মুরগির খামারিরা তাদের পশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতেও হিমশিম খাচ্ছেন। তপ্ত রোদের কারণে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হন না। আজ শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায় সড়কগুলো খাঁ-খাঁ করছে। লোকজন নেই বললেই চলে। দু-একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যা-ও বা খুলেছে তাও ক্রেতা শূন্য।
নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি পুকুরে কিশোর-যুবক এবং বয়স্ক বেশ কয়েকজন সাঁতার কাটছে। স্থানীয় বাসিন্দা জালাল মিয়া বলেন, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পুকুরে ডুব দিয়ে সবাই একটু শীতল পরশ নেয়ার চেষ্টা করছেন।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার সকাল ৯টায় রংপুরে তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন বুধবার ছিল ৩৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পাবে।
তীব্র গরমে অসুস্থ মানুষকে সেবা দিতে দিশেহারা মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
গত কয়েক দিনের টানা তাপপ্রবাহের কারণে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ডায়রিয়া ও গরমজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে গত পাঁচ দিনে অন্তত ২৫০ জন রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৮৫ জন। আর গরমের কারণে পানিশূন্যতা, পেটব্যথা, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে চিকিৎসা নিয়েছেন আরো ১৫০ জন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে গতকাল বৃহস্পতিবার ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৭ জন। ফলে বেডের অভাবে অনেক রোগীকে মেঝে ও বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রুমের বাইরে বৈদ্যুতিক পাখার সুবিধা না থাকায় গরমে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
গত বুধবার সন্ধ্যায় পিরপালি বাজার থেকে পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন কুরসিয়া বিবি (৬০)। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তিন দিন ধরে আমাকে বারান্দায় রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ নেই, ফ্যানও নেই। গরমে আর পেটব্যথায় একেবারে নাকাল অবস্থা। একটু ভালো জায়গা আর চিকিৎসার ঠিকঠাক ব্যবস্থা করলে সুস্থ হতে পারতাম।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে আলাপকালে তারা হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগের দাবি জানান।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা তাসনিম হুসাইন আরিফ বলেন, কোরবানির দিন থেকে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে হঠাৎ করেই রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। জনবল সঙ্কটে আমরা চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মাত্র চারজন চিকিৎসক নিয়ে ৫০ শয্যার হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও আবাসিক চিকিৎসাসেবা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। হঠাৎ রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বেড সঙ্কুলান হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অনেক রোগীকে মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। রোগীর চাপ এ রকম থাকলে আমাদের আরো সমস্যায় পড়তে হতে পারে।