তামাক কোম্পানির পাহাড়সম কর ফাঁকি

আবুল কালাম
Printed Edition

  • ‘তদূর্ধ্ব’ শব্দে মুল জটিলতা
  • বছরে ফাঁকি ৭ হাজার ৩শ’ কোটি
  • বিভ্রান্তিতে আইন সংশোধন বিলম্বিত

মাত্র একটি শব্দের সূত্রে পাওয়া সু্ইঁ পরিমাণ ফাঁকে দেশের তামাক কোম্পানিগুলো পাহাড়সম কর ফাঁকি দিচ্ছে। তামাক আইনের দুর্বলতার সুযোগে সিগারেটের মূল্য নির্ধারণে ’তদূর্ধ্ব’ শব্দটি সামগ্রিক ব্যবস্থাকে জটিল এবং ত্রুটিপূর্ণ করে তুলছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের সাথে তদূর্ধ্ব শব্দটি যুক্ত থাকায় কোম্পানিগুলো বিদ্যমান মূল্যস্তরের মাঝামাঝি একাধিক মূল্য/ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারজাত করার সুযোগ পাচ্ছে। এর মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো সরকারকে বছরে সাত হাজার ৩০০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিচ্ছে।

অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর (বিইআর) সিনিয়র কমিউনিকেশন অফিসার ইব্রাহিম খলিলের গবেষণায় তামাক কোম্পানির মূল্য কারসাজির এই তথ্য উঠে আসে। বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট (বাটা) ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসির (বিএনটিটিপি) যৌথ উদ্যোগে ‘সিগারেটের মূল্য নির্ধারণে তদূর্ধ্বের ব্যবহার ও তামাক কোম্পানির মূল্য কারসাজি’ শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল টকশোতে গত সপ্তাহে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো নিত্যনতুন কৌশলে তাদের পণ্যের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, বিভ্রান্তিকর তথ্যের মাধ্যমে তামাকের কর বৃদ্ধি ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গেও বেপরোয়া বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো। যা তামাক নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনকে শক্তিশালী করা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।

এ বিষয়ে ইব্রাহিম খলিল জানান, গবেষণায় তিনি প্রমাণ পেয়েছেন সরকার নির্ধারিত মূল্যের সাথে তদূর্ধ্ব শব্দটি যুক্ত থাকায় কোম্পানিগুলো বিদ্যমান মূল্যস্তরের মাঝামাঝি একাধিক মূল্য বা ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারজাত করার সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি প্রত্যেক ব্র্যান্ডের সিগারেট নির্ধারিত মূল্যের থেকে মূল্যস্তরভেদে ন্যূনতম ১০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে। এই অতিরিক্ত মূল্যের উপর কোনো করারোপ না করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।

বিএনটিটিপির প্রকল্প ব্যবস্থাপক হামিদুল ইসলাম হিল্লোল জানান, দেশে বিদ্যমান তামাক কর আদায় ব্যবস্থা ও তামাক কর কাঠামো জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট। পাশাপাশি মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ’তদূর্ধ্ব’ শব্দটি এই সামগ্রিক ব্যবস্থাকে আরো জটিল এবং ত্রুটিপূর্ণ করে তুলছে। এই একটি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের অধিক মূল্যে সিগারেট বিক্রয়ে বাধ্য করছে। এ ছাড়া প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পরপরই বর্ধিত মূল্যে পুরাতন অর্থবছরের সিগারেট বিক্রয় করে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিচ্ছে। এতে করে মাসে ৬০০ এবং বছরে সাত হাজার ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক সুশান্ত সিনহা জানান, তামাক কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই নতুন নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারজাত করে। মূল্য নির্ধারণে বিদ্যমান ‘তদূর্ধ্ব’ শব্দটির ব্যবহার করে বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি দেশীয় কোম্পানিগুলোও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করছে।

তামাকবিরোধী জোটের কর্মকর্তা সৈয়দা অনন্যা রহমান জানান, অনুসন্ধানে তারা দেখতে পেয়েছেন, তরুণদের আকৃষ্ট করতে তামাক কোম্পানিগুলো সব মূল্যস্তরেই বিভিন্ন ফ্লেভারের সিগারেট বাজারে এনেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ সিগারেটের মতোই এই ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সারের একটি বড় কারণ। এই সিগারেটে ব্যবহৃত সিনথেটিক মেনথল ফুসফুসের অ্যালার্জি, টনসিল ফোলাসহ দীর্ঘস্থায়ী অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

এ ছাড়া এসব সিগারেটে ব্যবহৃত আপেল, স্ট্রবেরি ও চকোলেট স্বাদের সুগন্ধি শীতল অনুভূতি জাগানোর কারণে আরো গভীরভাবে শ্বাস নিতে উৎসাহিত করে। ফলে শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ও আলকাতরা বেশি পরিমাণে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এই সিগারেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে যা খুবই উদ্বেগজনক।

প্রতিবেদনের সুপারিশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ায় ফ্লেভার সিগারেটকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করা জরুরি বলে অবহিত করা হয়। অপর এর প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো শিক্ষার্থী ও তরুণদের টার্গেট করে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এর মাধ্যমে তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করে তুলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে বা শিক্ষার্থীরা বেশি যাতায়াত করে এমন জায়গাগুলোতে গোপনে প্রচারণা চালাচ্ছে, যা অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের ধূমপানের প্রতি কৌতূহলী করে তুলছে।