বাংলাদেশে রফতানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে সরকার বন্ড সুবিধা চালু করেছিল। এই সুবিধার আওতায় রফতানি-উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ক ও কর ছাড়াই কাঁচামাল আমদানি করতে পারে, যাতে বৈদেশিক বাজারে তারা প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। তবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে প্রতি বছর সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এ সুবিধার সঠিক ব্যবহার না হয়ে বরং বহুলাংশে অপব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে এক দিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় কমছে, অন্য দিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে তৈরি হচ্ছে অসম প্রতিযোগিতা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য ১৯৮০-এর দশকে চালু হয় বন্ড সুবিধা। নীতি অনুযায়ী, রফতানির লক্ষ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আমদানির সময় শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। পরে এসব কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে রফতানি করতে হয়। এর মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমে যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ে।
তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় চার হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা ভোগ করছে। এর মধ্যে বড় অংশই তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি, চামড়া, ওষুধ, ফ্রোজেন ফুডসসহ বিভিন্ন খাতেও এ সুবিধা কার্যকর। এ দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার আওতায় কাঁচামাল আমদানি করলেও সেগুলো দিয়ে রফতানিযোগ্য পণ্য তৈরি না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে সরকারের শুল্ক আদায়ের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিষ্ঠান যদি বন্ড সুবিধায় এক লাখ মিটার কাপড় আমদানি করে, তার সবটাই রফতানি-উৎপাদনে ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে অনেকে সেই কাপড়ের একটি অংশ বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তারা পূর্ণ শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে প্রতি বছর সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন সীমিত জনবল ও পর্যাপ্ত নজরদারি ব্যবস্থার অভাবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না। একজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের অনেক সময় কাগজে-কলমে দেখানো হয় রফতানি হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে হয়নি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঁচামালের প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিত করার মতো প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই।’ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার শুধু সরকারের রাজস্ব ক্ষতিই করছে না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে দুর্বল করছে। স্থানীয় বাজারে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য বিক্রি হওয়ায় শুল্ক-পরিশোধকারী শিল্পগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) এক কর্মকর্তা বলেন, তারা নিয়ম মেনে শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করেন। কিন্তু যারা বন্ড সুবিধার কাঁচামাল দেশে বিক্রি করছে, তারা কম দামে পণ্য বাজারজাত করছে। এতে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান থাকলেও বেশির ভাগ সদস্য নিয়ম মেনে ব্যবসা করছে। সংগঠনটির এক পরিচালক বলেন, যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু এর দায় পুরো খাতের ওপর চাপানো যাবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্ড সুবিধা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সহায়তা। তবে এর অপব্যবহার রোধ করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি বাড়াতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কাঁচামাল আমদানির পর কোথায় ব্যবহার হচ্ছে তার তথ্য রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করা গেলে অপব্যবহার ঠেকানো সম্ভব হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি বলেছেন, রফতানি উৎপাদনের জন্য বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানি করা পণ্য বা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির প্রমাণ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা হবে। বন্ড সুবিধার আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো রফতানিমুখী পণ্য উৎপাদনের জন্য শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। কিন্তু এনবিআরের তথ্যমতে, অনেক প্রতিষ্ঠানই এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেন। এর বিরুদ্ধে বর্তমানে ‘বিআইএন লক’সহ (প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স আইডি স্থগিত করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করা) ফৌজদারি মামলা করে এনবিআর।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের সাথে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বন্ডের অপব্যবহার রোধে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে ট্যাক্স কমিশনারদের কাছে হালনাগাদ তথ্য চান এবং এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্সের’ ওপর জোর দেন। বন্ড অডিট কার্যক্রমের ফলাফল সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিটি সভায় উপস্থাপনের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি কাস্টমস হাউজগুলোতে নিলাম কার্যক্রম জোরদার করে কনটেইনার জট কমানোর নির্দেশনাও দেন তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে বন্দরে পড়ে থাকা কনটেইনার ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নিলামে বিক্রি করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এনবিআরের তিনটি অফিসের আওতায় বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। মূলত রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল ও অ্যাকসেসরিজ আমদানির সুবিধা দিতে বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। এর শর্ত হলো, আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য পুরোটাই রফতানি করতে হবে। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হলে ওই কাঁচামালের ওপরে প্রযোজ্য শুল্ক ও কর পরিশোধ করতে হবে।