নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ
- অবরোধে ক্ষুধায় কাতর সাধারণ মানুষ
- আরো এক বন্দীর লাশ ফেরত ইসরাইলের
গাজায় অন্তত দুই বছরের জন্য আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনার একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা না হলেও ইতোমধ্যে কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রকে প্রস্তাবের অনুলিপি দেয়া হয়েছে এবং আলোচনার ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজায় একটি ‘বোর্ড অব পিস’ নামে অন্তর্বর্তী প্রশাসনিক সংস্থা গঠন করা হবে। এটি যুদ্ধ-পরবর্তী শাসন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এই বোর্ডের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী বা আইএসএফ গঠন করা হবে। এই বাহিনী গাজায় নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে সহায়তা করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ও অন্যান্য অংশীদারদের সাথে আলোচনা চলছে। তিনি ‘গণমাধ্যমের হাতে আসা নথি’ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এই বাহিনী ‘প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে পারবে যার অর্থ প্রয়োজনে বল প্রয়োগও অনুমোদিত।
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, এই বাহিনী ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে মোতায়েন শুরু হোক এবং ২০২৭ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকুক। পরবর্তীতে প্রয়োজনে এর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। এই পরিকল্পনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গাজা শান্তি উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই প্রস্তাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, গাজার ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামোতে ফিলিস্তিনি জনগণের অংশগ্রহণ ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা জরুরি।
যদিও এখনো কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি, তবে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এই প্রস্তাব গাজায় যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরির চেষ্টা হলেও, এর সফলতা নির্ভর করবে জাতিসঙ্ঘের অনুমোদন এবং আঞ্চলিক পক্ষগুলোর সমর্থনের ওপর। কপ৩০ সম্মেলনের প্রাক্কালে এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।
দক্ষিণ গাজায় গোলাবর্ষণ
এ দিকে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলে তীব্র গোলাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ওয়াল্লা জানিয়েছে, ইসরাইলি যুদ্ধবিমান রাতভর খান ইউনুসের পূর্বাংশ এবং বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের আশপাশে একাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করে বলেছে, মানবিক সংস্থাগুলো এখন ‘সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই’ করছে। কারণ ইসরাইলি অবরোধ গাজার অবশিষ্ট সরবরাহ পথগুলোকে কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মুখপাত্র আবির এতেফা বলেন, গত মাসের যুদ্ধবিরতির পর ত্রাণ সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও, ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞার কারণে মাত্র দুটি সীমান্ত পথ খোলা রয়েছে, যা খাদ্য ও সরবরাহ প্রবাহকে মারাত্মকভাবে সীমিত করছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার দরকার। সব কিছু দ্রুত চলা দরকার। আমরা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ছি। শীত আসছে। মানুষ এখনো ক্ষুধায় ভুগছে, চাহিদা সীমাহীন।’ ডব্লিউএফপি গাজায় ৪৪টি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র পরিচালনা করছে এবং ১০ অক্টোবরের যুদ্ধবিরতির পর দশ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। তবে এতেফা বলেন, সরবরাহ এখনো ভয়াবহভাবে অপর্যাপ্ত, বিশেষ করে উত্তর গাজায় যেখানে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘উত্তর গাজার সীমান্ত পথগুলো বন্ধ থাকাই বড় বাধা। ত্রাণবাহী গাড়িগুলোকে দক্ষিণ থেকে ধীর, ঝুঁকিপূর্ণ পথে যেতে হচ্ছে। বড় পরিসরে সহায়তা পৌঁছাতে সব সীমান্ত পথ, বিশেষ করে উত্তর দিকেরগুলো খুলতে হবে।’ ইসরাইলি বাহিনী আংশিকভাবে ‘হলুদ রেখা’ পর্যন্ত পিছু হটলেও, উত্তর গাজায় ফিরে আসা হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শুধুই ধ্বংসস্তূপ পেয়েছেন। দুই বছরের ইসরাইলি বোমাবর্ষণে পুরো পাড়া-মহল্লা গুঁড়িয়ে গেছে, মানুষ তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়ে বাস করছে।
জাতিসঙ্ঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো বারবার ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার এবং গাজায় আরো ত্রাণ ঢুকতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে, শীতকালীন দুর্ভোগের আশঙ্কা তুলে ধরে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ১০ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গাজায় মাত্র ৩,২০৩টি বাণিজ্যিক ও ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে গড়ে প্রতিদিন ১৪৫টি, যা প্রতিশ্রুত ৬০০ ট্রাকের মাত্র ২৪ শতাংশ।
এ দিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের ধ্বংসাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গত মঙ্গলবার গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় ইসরাইলি ড্রোন গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা এবং আরেকজনকে আহত করেছে। আল-আহলি আরব হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, জাবালিয়ায় ইসরাইলি গুলিতে আরো একজন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬০৭ জন আহত হয়েছেন।
আরো এক বন্দীর লাশ ফেরত
গাজা থেকে রেড ক্রসের মাধ্যমে গত মঙ্গলবার হামাসের হস্তান্তর করা একটি লাশ গ্রহণ করেছে ইসরাইল, জানিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস জানায়, তারা গাজা শহরের পূর্বাঞ্চলীয় শেজাইয়া এলাকায় একজন নিহত ইসরাইলি বন্দীর লাশ খুঁজে পেয়েছে, যেটি হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর নিশ্চিত করেছে, লাশটি স্টাফ সার্জেন্ট ইটাই চেনের। হামাস জানায়, শেজাইয়ার ওই এলাকায় ইসরাইলি বাহিনী এখনো অবস্থান করছে। তবে ইসরাইল হামাস ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির দলগুলোকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেয়, যার পর লাশটি উদ্ধার করা হয়। চেন ছিলেন একজন সেনা সদস্য, যিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার সময় দক্ষিণ ইসরাইলের শহর ও সামরিক ঘাঁটিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের নিন্দা গুতেরেসের
গাজায় বারবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গত মঙ্গলবার কাতারের দোহায় দ্বিতীয় বিশ্ব সামাজিক উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে সাংবাদিকদের উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি। গুতেরেস বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং সব পক্ষকে শান্তি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে।’
হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও ইসরাইল প্রায় প্রতি দিনই তা লঙ্ঘন করেই চলছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইল ১২৫ বারের বেশি লঙ্ঘন করেছে। সেই সাথে শতাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। গাজা অঞ্চলজুড়ে ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। একই সময়ে এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে।
অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। চলতি বছরের শুরুতেও একটি যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ইসরাইল গত ২৭ মে থেকে গাজায় পৃথক সাহায্য বিতরণ উদ্যোগ শুরু করে। এই পদক্ষেপের পর অঞ্চলটিতে দুর্ভিক্ষ প্রকট হয়ে উঠেছিল। ইসরাইলি বাহিনী খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপরও গুলি চালিয়ে যায়। এর ফলে শত শত মানুষ নিহত হয়। সেই সাথে দুর্ভিক্ষে শিশুসহ বহু মানুষের মৃত্যু হয়।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। উপত্যকাজুড়ে যুদ্ধের জন্য ইসরাইল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখি।



