- চরম দুর্ভোগে মানুষ, মরিচা ধরেছে সেতুর রডে
- মেয়াদ বাড়িয়েও ফেরেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া সড়ক প্রকল্পের কাজ মাঝপথে ফেলে উধাও হয়ে গেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রায় এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বারইয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ গত আট মাস ধরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে শুধু ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য গতিশীল করার পরিকল্পনা হোঁচট খায়নি, বরং সড়কের নির্মাণাধীন অংশে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে চরম জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চার দিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও কোনো নির্মাণযজ্ঞ নেই। ফটিকছড়ির বাগান বাজার কাজী মাদরাসার সামনে সড়কটির অবস্থা বেহাল। নির্মাণাধীন সেতু ও কালভার্টগুলোর পাশে ফেলে রাখা রডে মরিচা ধরেছে। অর্ধেক খুঁড়ে রাখা সড়কের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যাওয়ায় এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দরের সাথে যুক্ত করতে এই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ভারত সরকারের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি-৩) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ১৮ ফুট থেকে ৩৮ ফুটে উন্নীত করার কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থায় কাজ ফেলে উধাও হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘অশোকা বিল্ডকন লিমিটেড’। আট মাস ধরে কাজ বন্ধ থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের (২০২৫) ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি ঠিকাদারের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অশোকা বিল্ডকন লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সন্দীপ দে হোয়াটসঅ্যাপে জানান, তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। কাজ বন্ধের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি।
একই সুর প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদ হোসেনের কণ্ঠেও। তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনে কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। সেটা বর্তমানে কেটে গেছে। আমরা ঠিকাদারকে ৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার সড়ক বুঝিয়ে দিতে পেরেছি। বন বিভাগের সাথে কিছু সমস্যা ছিল, সেটিরও সমাধান হয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করলেও মাত্র তিন মাসে প্রকল্পের বাকি ৫০-৫৫ শতাংশ কাজ শেষ করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মোসলেহ উদ্দিনও প্রকল্পের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিছু সমস্যা ছিল। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সহজ করতে ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ৩৮ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার পাশাপাশি ২৪৯.২ মিটারের ৯টি সেতু এবং ১০৮ মিটারের ২৩টি কালভার্ট নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৫১৩ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং ভারত সরকার ঋণ দিচ্ছে ৫৯৪ কোটি ৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহন বারইয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে। এতে সময় ও পরিবহন ব্যয় যেমন কমবে, তেমনি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথেও সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে, যা দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হয়েছিল।
কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এমন আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়ায় পুরো প্রকল্পটিই এখন অনিশ্চয়তার মুখে। হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বপ্ন এবং স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগ; সবকিছুই এখন ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ফেরার অপেক্ষায় আটকে আছে।
মিরসরাই প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম মাঈন উদ্দিন বারইয়ারহাট সড়ক দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ রাস্তায় প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। ঢাকা-খাগড়াছড়ির একমাত্র সড়ক এটি। মানুষের কষ্ট হচ্ছে। অবিলম্বে সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা না হলে দুর্ভোগ চরমপর্যায়ে পৌঁছাবে।