পাহাড়-সমুদ্রের মিলনস্থল মিরসরাই

পর্যটনে বড় বাধা আবাসন সঙ্কট

পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগামী ১০ বছরে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এর ফলে দেশী-বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
Printed Edition
পাহাড়-সমুদ্রের মিলনস্থল মিরসরাই
পাহাড়-সমুদ্রের মিলনস্থল মিরসরাই

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার ঐশ্বর্য। একপাশে নীল সমুদ্র, অন্যপাশে সবুজে মোড়া উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনা, কৃত্রিম লেক, আঁকাবাঁকা সড়ক, ম্যানগ্রোভ বন, নদী আর সৈকত- সব মিলিয়ে এক উপজেলাতেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনন্য সমাহার। এখান থেকে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল ও জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। শীতকালে কুয়াশায় মোড়া গ্রামবাংলা কিংবা মেঘলা দিনে পাহাড় আর মেঘের খেলা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। সন্ধ্যায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্প কারখানার বাতি জ্বলে উঠে এখানে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে।

মিরসরাইয়ে বর্তমানে প্রায় ২০টি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মহামায়া ইকো পার্ক, খৈয়াছড়া ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি হ্রদ, রূপসী ঝরনা, বাওয়াছড়া হ্রদ, মেলকুম ট্রেইল, সোনাপাহাড়, বোয়ালিয়া ঝরনা, হরিনাকুণ্ড ঝরনা, আরশিনগর ফিউচার পার্ক, মুহুরী প্রকল্প, ডোমখালি সৈকত, বসুন্ধরা সৈকতসহ আরো অনেক স্থান সবার কাছেই জনপ্রিয়। বিশেষ করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ মহামায়া ও আটস্তর বিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।

প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক মিরসরাই ভ্রমণে আসেন বলে বেসরকারি ও বন বিভাগের হিসাব জানা যায়। তবে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর তুলনায় আবাসনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। মাত্র দুই-তিনটি বেসরকারি হোটেল ও রেস্তোরাঁ থাকলেও সেগুলোর মানও ভালো নয়। ফলে বেশির ভাগ পর্যটককে সকালে এসে বিকেলে ফিরে যেতে হয়। এখানে রাত্রীযাপনের সুযোগ না থাকায় স্থানীয় অর্থনীতিও প্রত্যাশিত সুবিধা পাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফতিখার মাহমুদ চঞ্চল বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন জায়গা দেশে বিরল। তবে নিরাপত্তা ও আবাসনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা রাত কাটাতে পারি না। বর্ষায় ভিড় বাড়লেও সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়ে ওঠে।

মিরসরাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সোনালী স্বপ্ন’-এর প্রতিষ্ঠাতা মঈনুল হোসাইন টিপু বলেন, দেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে একসাথে সাগর, নদী, লেক, পাহাড়, ঝরনা, ম্যানগ্রোভ বন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী- এমন বৈচিত্র অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সে তুলনায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। বন বিভাগ প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ইজারা দিলেও ঝরনাগুলোতে নিরাপত্তা বা অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর অনেক পর্যটক মারা যাচ্ছেন।

এ বছর মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের পাঁচটি ঝরনা ইজারা নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এ আর এন্টারপ্রাইজ’। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা এস এম হারুন বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে সতর্কতামূলক ব্যানার টাঙিয়েছি, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ওঠা নিষিধ করেছি, লেকে নৌভ্রমণে লাইফ জ্যাকেটের সংখ্যা বাড়িয়েছি। তারপরও কিছু পর্যটক নির্দেশনা মানেন না। তবে আবাসনের অভাব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে হোটেল-মোটেল তৈরি জরুরি।

পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দাবি, পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগামী ১০ বছরে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এর ফলে দেশী-বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার বলেন, পর্যটনশিল্প বিকাশে বন বিভাগ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, ইজারাদার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সাংবাদিকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়েছে। আমরা পর্যটকদের সচেতন করছি। কিভাবে পর্যটনকে আরো সমৃদ্ধ করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, মিরসরাইয়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও অবকাঠামো ঘাটতি ও নিরাপত্তা সঙ্কট বড় বাধা। আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা জোরদার, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এ অঞ্চল পর্যটনের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠবে।