ওপারে ভারতের অমানবিকতা

পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত বাঙালিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দিতে অমানবিক কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। একই সাথে ভারতে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ কার্যক্রম-স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ রিভিশনের (এসআইআর) দোহাই দিয়ে দেশটির সরকার তাদের পুলিশ ও বিএসএফকে পুশইনের নির্দেশ দিয়েছে। ওই নির্দেশনার পর সাত শতাধিক বিএসএফ সদস্য ওপারে মহড়া দেয়া শুরু করেছে।

এস এম মিন্টু
Printed Edition

  • সীমান্তে পুশইনে মরিয়া বিএসএফ, বাড়ছে হত্যা

  • অপেক্ষায় রাখা ৬ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর মানবেতর জীবনযাপন

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত বাঙালিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দিতে অমানবিক কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। একই সাথে ভারতে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ কার্যক্রম-স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ রিভিশনের (এসআইআর) দোহাই দিয়ে দেশটির সরকার তাদের পুলিশ ও বিএসএফকে পুশইনের নির্দেশ দিয়েছে। ওই নির্দেশনার পর সাত শতাধিক বিএসএফ সদস্য ওপারে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। মোদী সরকারের কঠোর বার্তায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে কুড়িগ্রামের ওপারে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকার পাশে বসবাসরত বাংলাভাষী সাধারণ মানুষকে পুলিশ সদস্যরা গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। পাশাপাশি বিএসএফ সদস্যরা আরো নিরীহ মানুষকে বাংলাদেশে জোরপূর্বক ঠেলে পাঠানোর (পুশইন) প্রস্তুতি নিয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দফতর বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। অপর দিকে বিএসএফের গুলি ও পিটুনিতে সীমান্ত হত্যা ক্রমেই বাড়ছে। একদিকে পুশইন, অন্য দিকে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশীদের প্রতি চরম অমানবিক আচরণের অভিযোগ উঠেছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শুধু নির্বিচার হত্যাই নয়, সীমানা লঙ্ঘন করে সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ছাগল চুরিরও অভিযোগ উঠে ভারতীয় বাহিনীটির বিরুদ্ধে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তর সীমান্ত এলাকায় টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। যাতে কোনোভাবে ওপার থেকে অবৈধভাবে জোরপূর্বক পুশইনের মাধ্যমে কোনো নারী-শিশু পুরুষ প্রবেশ করতে না পারে।

সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে বহুল আলোচিত ভারতীয় অন্তঃসত্ত্বা নারী সোনালী খাতুন ও এক শিশুকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে অমানবিকভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পুশইন করেছিল বিএসএফ। বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। পরে ভারতীয় হাইকমিশনের নির্দেশে এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সোনালী খাতুন ও শিশুকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে বিএসএফের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে সাতক্ষীরার ওপারে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কুড়িগ্রামের ওপারের সীমান্ত পর্যন্তÍ বিএসএফের প্রতি ক্যাম্পে পাঁচ থেকে ছয়জন করে সাত শতাধিক সদস্য বাড়ানো হয়েছে। বিজিবি ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ওপারে বাংলাদেশ থেকে মাছ ধরতে গিয়ে এবং সেখানে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গিয়ে অনেকে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। সম্প্রতি ভারত সরকারের কঠোর নির্দেশনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশীদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। শিগগিরই তারা না ফিরলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। সূত্র জানায়, যাদের গ্রেফতার করা হবে তাদের ওই দেশে অবৈধ বসবাসকারী হিসেবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এমন সংবাদের পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ঠেলে দিতে সীমান্তে বিএসএফের সদস্য বৃদ্ধি এবং মহড়া চলছে। এর মধ্যে ছয় শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশুকে সীমান্তের ওপারে পুশইনের জন্য অপেক্ষায় রাখায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিএসএফের সদস্যরা তাদের পুশইনের জন্য কৌশল খুঁজছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, ভারতে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ কার্যক্রমকে (স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ রিভিশন-এসআইআর) কেন্দ্র করে সীমান্তবর্তী বশিরহাট থানাধীন তারালী ও হাকিমপুর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যথাযথ নাগরিকত্বের প্রমাণের নথিপত্রবিহীন অনিবন্ধিত জনসাধারণ (কথিত বাংলাদেশী নাগরিক) সীমান্ত এলাকায় জড়ো হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবির সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ন (৩৩ বিজিবি)।

সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে সাতক্ষীরার বিজিবি ৩৩ ব্যাটালিয়নের সদর দফতর থেকে জানানো হয়, গত ৪ নভেম্বর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বুথ লেভেল অফিসারদের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। কর্মকর্তারা পশ্চিমবঙ্গের সব ভোটারের বাড়িতে যাবেন এবং জাতীয় ভোটার যোগ্যতা নিশ্চিত করবেন। এসআইআর ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ও সাধারণ জনসাধারণের, বিশেষত মুসলিম নাগরিকদের মধ্যে বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজ্য শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি এসআইআরের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে।

এরই অংশ হিসেবে গত ১ নভেম্বর ভারতীয় পুলিশ ৪৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। পরে আটককৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় নাগরিক দাবি করলে তাদের ফের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য বশিরহাটে হাজির করা হয়। এ ছাড়াও ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের কথিত বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে ভারতীয় পুলিশ ও বিএসএফের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়।

যেসব সীমান্তে বিএসএফ বাড়ানো হয়েছে : পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো (উত্তর থেকে দক্ষিণ) জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার সীমান্তে বিএসএফের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের সাথে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুর জেলার এবং মালদা, মুর্শিদাবাদও কাছাকাছি, যা কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর ও পশ্চিম দিকের সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোর অংশ, যেখানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা একে অপরের সাথে সংযুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা (বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর) জলপাইগুড়ি যা কোচবিহারের সাথে যুক্ত এবং কুড়িগ্রামের উত্তর-পশ্চিম অংশ ছুঁয়ে আছে আলিপুরদুয়ার কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির পশ্চিমে অবস্থিত, ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অংশও রয়েছে। কোচবিহারের বাংলাদেশের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। উত্তর দিনাজপুর কোচবিহারের দক্ষিণে এবং মালদার উত্তরে অবস্থিত। দক্ষিণ দিনাজপুর ও উত্তর দিনাজপুরের দক্ষিণে ও মালদার উত্তরে।

মালদা বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সাথে সীমান্ত ভাগ করে। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম সীমান্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম, বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাথে যুক্ত। নদিয়া মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে, বাংলাদেশের মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার সাথে সীমান্ত রয়েছে।

উত্তর ২৪ পরগণা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশে, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার সাথে যুক্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগণা সুন্দরবন অঞ্চলের কারণে সীমান্ত রেখাটি এখানে ভিন্ন প্রকৃতির। কুড়িগ্রামের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুর জেলার অংশগুলো সীমান্ত বরাবর রয়েছে, যা ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সাথেও কুড়িগ্রামের সংযোগ স্থাপন করে।

তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করতে সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিএসএফের সাত শতাধিক সদস্য বাড়তি মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জোরপূর্বক পুশইন ও সীমান্তে অস্থিরতা তৈরি করা তাদের উদ্দেশ্য বলে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।