হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্গঠন শুরু হওয়ার পর গত এক বছরে এতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পর, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতকেন্দ্রিক অবস্থান থেকে সরে এসে আরো বৈচিত্র্যময় কূটনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীন, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো পশ্চিমা শক্তির সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করার চেষ্টা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে হাসিনার শাসনের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত ভারত এখন বাংলাদেশীদের সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে, যারা দেশটির বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাটের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এমন অভিমত তুলে ধরে বলা হয়েছে গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের মধ্যে দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক প্রতিষ্ঠা পায়। এই সফর বেইজিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে উত্থানের ওপর জোর দেয়। বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ, বিনিয়োগ এবং অনুদান নিশ্চিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামে চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। ইয়ারলুং সাংপো-যমুনা নদীর সাথে সম্পর্কিত অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন এবং জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগির মতো ক্ষেত্রগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে আটটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের নতুন করে আগ্রহ, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সাথে উত্তেজনার কারণে স্থগিত ছিল- ভারতীয় প্রভাবের প্রতি পাল্টা ওজন হিসেবে বেইজিংয়ের দিকে ঢাকার কৌশলগত অবস্থানকে চিত্রিত করে।
অন্যান্য ফলাফলের মধ্যে রয়েছে চীনে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী রফতানির ৯৯ শতাংশের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, চীনা ঋণের সুদের হার হ্রাস এবং টেক্সটাইল, ওষুধ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চীনা কারখানা স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা। তা ছাড়া, মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছে যে চীন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারদসহ বেশ কয়েকটি দেশে সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের কথা বিবেচনা করছে। তবে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এই প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছেন, অস্বীকার করে বলেছেন চীনের বাংলাদেশকে নিয়ে এমন কোনো ইচ্ছা নেই।
সরাসরি চট্টগ্রাম-কুনমিং ফ্লাইট চালু এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি দুই দেশের এই ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বকে আরো দৃঢ় করেছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য ঢাকার প্রচেষ্টার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।
চীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও যোগাযোগ রেখেছে। ২০২৫ সালের জুন এবং জুলাই মাসে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপি এবং জামায়াত উভয়ই চীনে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি দল, সিসিপি পলিটব্যুরো সদস্য লি হংঝংয়ের সাথে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করে, যিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানান। প্রায় একই সময়ে, জামায়াতের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলদল ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর আলোকপাত করে। হাসিনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এই সফরগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বেইজিংয়ের প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে।
একই সময়ে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করেছে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বোঝার কারণে হাসিনার অধীনে টানাপড়েনের মধ্যে ছিল। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, নির্মাণ, খাদ্য, ওষুধ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে নতুন সহযোগিতার মাধ্যমে। একটি যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ গঠন এবং পাকিস্তানের ৩০০টি সম্পূর্ণ অর্থায়িত বৃত্তি প্রদানের প্রস্তাব ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার ইঙ্গিত দেয়। প্রতিরক্ষা সম্পর্কও এগিয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যৌথ মহড়া এবং বাংলাদেশের ফোর্সেস গোল ২০৩০ আধুনিকীকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেএফ-১৭ থান্ডার জেট কেনার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আঞ্চলিক গতিশীলতার আরো পরিবর্তনের লক্ষণ হিসেবে, জুন মাসে কুনমিংয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে চীন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকা কোনো জোটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, সময়টি ক্রমবর্ধমান সমন্বয়ের ইঙ্গিত দেয়। এই ঘটনাবলি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত ভূদৃশ্য পুনর্গঠনের বেইজিংয়ের বৃহত্তর উচ্চাকাক্সক্ষার দিকে ইঙ্গিত দেয়ার পাশাপাশি ভারতের ঐতিহ্যবাহী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বাংলাদেশ যে তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চীনের কৌশলগত উপস্থিতির এই সাম্প্রতিক কার্যকলাপ নয়াদিল্লির দৃষ্টি এড়ায়নি। চীনে ইউনূসের পূর্ববর্তী মন্তব্য, বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার এবং চীনের অর্থনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা ভারত স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। বাংলাদেশে, ভারত হাসিনার শাসনকে সমর্থন করেছিল এই ধারণা জনসাধারণের অবিশ্বাসকে আরো গভীর করেছে। এর ফলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের তীব্র অবনতি ঘটেছে।
হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য ঢাকার দাবির ফলে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায়, তাকে তার মেয়াদকালে দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি করার জন্য বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হোক। আইনি ও কূটনৈতিক জটিলতার কারণে ভারতের এই আদেশ মানতে অনীহা বাংলাদেশে এই অভিযোগকে আরো তীব্র করে তুলেছে যে তারা একজন অখ্যাত নেতাকে আশ্রয় দিচ্ছে। এই অচলাবস্থা ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরো গভীর করেছে, অনেক বাংলাদেশী নয়াদিল্লির এই অবস্থানকে তাদের দেশের বিষয়ে অব্যাহত হস্তক্ষেপের প্রমাণ হিসেবে দেখছেন।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং প্রতিযোগিতামূলক বক্তব্যের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। চীন ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের উষ্ণ সম্পর্ক, বিশেষ করে ত্রিপক্ষীয় কুনমিং বৈঠক, যা নয়াদিল্লি তার প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, তার প্রতিক্রিয়ায়, ভারত বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার, বিশেষ করে হিন্দুদের অধিকার রক্ষায় তার বক্তব্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি করলেও ঢাকা বিষয়টিকে হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে। তবে, বাংলাদেশের সমালোচকরা ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রেকর্ডের কারণে সংখ্যালঘুদের অধিকারের ওপর মনোযোগকে ভণ্ডামি বলে মনে করেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রাঙ্গণে হামলার মতো ঘটনা ঘটে, যেখানে ভারতীয় উগ্র ডানপন্থী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়, সম্পর্কের গতিপথের জন্য এসব বিষয় একটি সতর্কতা সঙ্কেত হিসেবে কাজ করেছিল। এই হামলা ঢাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগরতলায় হামলাকে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন হিসেবে নিন্দা জানায়, যা আরো দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
হাসিনার শাসনামলের জবাবদিহিতার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাপ এবং বাংলাদেশে পা রাখার জন্য ভারতের কৌশলগত বাধ্যবাধকতা ইঙ্গিত দেয় যে, প্রত্যর্পণ সমস্যা এবং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের সমাধান না করা পর্যন্ত সম্পর্ক অস্থির থাকবে।
হাসিনার বিদায়ের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি স্পষ্টভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। দেশটি ভারতের ওপর তার অত্যধিক নির্ভরতা থেকে সরে এসে চীন, পাকিস্তান এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আরো শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলছে। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ যত বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে, ভারতের সাথে সম্পর্ক ততই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষই যদি একটি সাধারণ ভিত্তি খুঁজে না পায় তবে এই অবিশ্বাস রয়ে যেতে পারে।