স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর জালিয়াতি

নামী-দামি ব্রান্ডের স্টিকার লাগিয়ে সরকারি হাসপাতালে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ

আবু সালেহ আকন
Printed Edition

গরিবদের নির্ভরতার কেন্দ্র সরকারি হাসপাতাল এখন আস্থা সঙ্কটে! আর এ জন্য দায়ী ঠিকাদার মোতাজ্জেরল ইসলাম মিঠু ও তার চক্র। বেনামি কোম্পানির যন্ত্রে নামি ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। ফলাফল ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট, চিকিৎসাগত ত্রুটি ও রোগীদের বিদেশে যেতে বাধ্য হওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।

সরকারি হাসপাতাল হলো সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল। আর এসব প্রতিষ্ঠানেই ঠিকাদার মিঠু সরবরাহ করেছেন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগানো মানহীন যন্ত্রপাতি। কার্যাদেশের বিপরীতে কখনো বা দিয়েছেন রিকন্ডিশন (পুরনো) মেডিক্যাল সামগ্রী। অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ডেনমার্ক ও জাপানের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগানো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বেড, অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি, ফ্রিজার, এনালাইজারসহ বিভিন্ন মানহীন পণ্য সরবরাহ করেছে মিঠু চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিঠু বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও আইএসটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করতেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর দেশের অন্তত ২০ লাখ রোগী ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে যান। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণের নেপথ্যে ভুল ডায়াগনসিস। আর ভুল ডায়াগনসিসের নেপথ্যে ভুয়া স্টিকার লাগানো নিম্নমানের যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়টা শেষপর্যন্ত চিকিৎসকদের ওপর পড়ে। একাধিক ডাক্তার বলেছেন, মানুষের রোগ নির্ণয়ের মূল উপাদান আধুনিক যন্ত্রপাতি। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লেখেন। রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি ভুয়া হলে চিকিৎসক কিভাবে সঠিক চিকিৎসা দেবেন? ফলে ভুল চিকিৎসার পথ তৈরি হয়। ভুল রিপোর্টে ওষুধ লিখলে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে মিঠুচক্র জাপানের ইয়োংগটাই ব্র্যান্ডের এলসি-১০০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (১২ হোল), এলসি ১০ সি মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (১২ হোল), কেডিসি ৪০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (২৪ হোল), টিজিএল ১৬ মডেলের রেফ্রিজারেটেড সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, জাপানের ফিজিওমেড ব্র্যান্ডের ফিজিওপ্লাস মডেলের শর্ট ওয়েব থেরাপি মেশিন সরবরাহ করেন। জার্মানির হাইয়ার ব্র্যান্ডের ডিএস ২ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (ডাবল ডোর), এইচওয়াইসি-৯৪০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (স্টান্ডার্ড ফর রিসেন্ট প্রিজার্ভেশন), এইচওয়াইসি-৩৬০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (স্টান্ডার্ড ফর রিসেন্ট প্রিজার্ভেশন), ব্র্যান্ডের এইচবিডি ২৮৬ মডেলের ভ্যাকসিন অ্যান্ড আইস প্যাক ফ্রিজার, এইচএক্সসি ১৫৮/৩৫৮ মডেলের ব্লাডব্যাংক রেফ্রিজারেটর, এইচওয়াইসি-৩৬০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটার, এইচবিডি ২৮৬ মডেলের ভ্যাকসিন অ্যান্ড লিও প্যাক ফ্রিজার-২৫সি, এইচওয়াইসি-৩৬০ ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর, এইচওয়াইসি-৯৪০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (ডাবল ডোর), জার্মানির শিনভ্যা ব্র্যান্ডের এসএক্সটিআই৫০০এফজেডকিউ/এস এক্সটি ৩০০এফডিকিউ হেভি ডার্টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াশিং মেশিন (ক্লথ), এমএসডি.বি মডেলের স্টালাইজার ভ্যাকুম টাইপ, ডেভিড ব্র্যান্ডের এইচকেএন ৯০১০ মডেলের রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার, ডিরুই ব্র্যান্ডের এইচ ৫০০ মডেলের সেমি অটোমেটেড ইউরিন কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও আইএমএস ব্র্যান্ডের আইএমএস৯৭২এ মডেলের ইলেকট্রোলাইট অ্যানালাইজার। এ ছাড়া জার্মানির এইচসিবি-০৪এলওয়াই মডেলের গাইনোকোলজি বিভাগের টেবিল, এইচসিবি-০৪এলওয়াই মডেলের টেবিল ফর গাইনোকোলজি সরবরাহ করা হয়। অথচ জার্মানিতে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব নেই। আবার ডেনমার্কের লিনাক ব্র্যান্ডের আরএস ১০১ মডেলের আইসিইউ বেড, আরএস ১০১ মডেলের পেশেন্ট এক্সামিনেশ বেড স্টান্ডার্ড, আরএস ১০১ মডেলের আইসিইউ বেড, ডিএস-২ মডেলের অপারেটিং টেবিল আই, ডিএস ২ মডেলের অপারেটিং টেবিল আই, আরএস ১০১ মডেলের পেশেন্ট এক্সামিনেশন বেড সরবরাহ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেরি ব্র্যান্ডের জেরি-এইচপ্লাস মডেলের পালস অক্সিমিটার, এক্সসি-এ৩০০ মডেলের অটোমেটেড ইএসআর অ্যানালাইজার এবং যুক্তরাজ্যের ড্রাগন ব্র্যান্ডের ডি ৩০২৪ মডেলের হাই স্প্রিড মাইক্রো সেন্ট্রিফিউজ, ডি ৩০২৪ মডেলের হাই স্প্রিড মাইক্রো সেনট্রিফিউজ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এসব ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে কেনাকাটার নামে সবচেয়ে বড় পুকুর চুরি করেছে ঠিকাদার মিঠুচক্র। এ চক্রের হাত ধরে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রচল, ভুয়া স্টিকারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে সরকারি হাসপাতাল সয়লাব। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার, দুর্নীতিবাজ কেনাকাটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও লুটেরা রাজনীতিবিদরা দায় এড়াতে পারেন না। মিঠুর দুর্নীতি স্বাস্থ্য খাতে অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। দুদকের মামলায় গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে গোয়েন্দা পুলিশ মিঠুকে গ্রেফতার করে।