দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং আগামী নির্বাচনে ইমেজ ধরে রাখতে কাজ করছে বিএনপি। জুলাই-আগষ্টের অভ্যুত্থান পরবর্তী আগামীর বাংলাদেশ গড়তে নানামুখী কর্মসূচি পালনও করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে সব কিছুকে ভণ্ডল করে দিতে দলের কিছু নেতাকর্মী একের পর এক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। যার পুরো দায়ভার দলকেই নিতে হচ্ছে। বিএনপির হাইকমান্ড এসব নেতাকর্মীকে নিবৃত করার জন্য কঠোর অবস্থান নেয়ার পরও দমানো যাচ্ছে না তাদের। এতে বিপাকে পড়ছেন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানান, জিরো টলারেন্স নীতিতে এরই মধ্যে সারাদেশে সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, শোকজ, পদাবনতিসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা তুলে নেয়া হলেও নিজেকে শোধরাতে পারেননি। তারা আগের মতো অপকর্মে নিজেদের জড়িয়ে দলকে বিব্রত করছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগ জমা হয়েছে। এ রকম একটি লিখিত অভিযোগ দলের নেতাকর্মীরা জানান, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেয়ার ঘটনায় ওই সময়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় বিএনপি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে বক্তারা এনামের স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসা করেছেন এনাম, যার কারণে বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নেতাকর্মীরা জানান, চাঁদাবাজি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান দখল, রাজনৈতিক আঁতাত ও অডিও ফাঁস স্থানীয় নেতাকর্মীদের ক্ষোভে দলের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নের মুখে। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এখন স্থানীয় রাজনীতির সবচেয়ে সমালোচিত নাম। আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত এবং সম্প্রতি একাধিক অডিও ফাঁসকে ঘিরে তাকে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে অভিযোগ, কোলাগাঁও এলাকার অন্তত সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এনামের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্লান্ট, জুডিয়াক ৬০ মেগাওয়াট, আনলিমা, বাংলাদেশ স্প্রিং মিলস, রিজেন্ট, আল বারাকা ও আনলিমা পাওয়ার প্যাক।
এনামুল হক এনামকে ঘিরে বিতর্ক আরো ঘনীভূত হয় যখন দুটি অডিও ফাঁস প্রকাশ্যে আসে। প্রথম অডিও (৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড) : বিএনপির সদস্যসচিব খোরশেদ আলম এবং উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সামশুল ইসলামের কথোপকথন। এতে খোরশেদকে সামশুলকে আশ্বস্ত করতে শোনা যায়-তিনি গ্রেফতার হবেন না, ভবিষ্যতেও কোনো মামলায় নাম আসবে না। খোরশেদ বলেন, এনাম ভাই বলেছে, এটা টেকনিক্যালি কভার করবেন। দ্বিতীয় অডিও (৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড) : সামশুল ইসলাম ও সৌদি প্রবাসী জিয়াউল হকের কথোপকথনে উঠে আসে গাড়ির দাবি, তেলের ব্যবসায় ভাগ চাওয়ার প্রসঙ্গ এবং শিল্পের লাভের অঙ্ক ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা। সেখানে খোরশেদ আলম ও এনামের নামও আসে।
উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব খোরশেদ আলম দাবি করেন, তাকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অডিও ফাঁস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া আপত্তিকর কিছু হয়নি। গাড়ি বা ব্যবসা ভাগ চাওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ বিষয়ে এনামুল হক এনাম বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সারাদেশে এমন কয়েক নেতার অপকর্মে তৃণমূল নেতাকর্মীরা যেমন বিব্রত তেমনি হাইব্রিড নেতাদের দাপটেও কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন ত্যাগী আর যোগ্যরা। নারায়নগঞ্জ-৩ আসনে (সোনারগাও-সিদ্ধিরগঞ্জ) বিগত বছরগুলোতে নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন আজহারুল ইসলাম মান্নান। কিন্তু দলের সুদিনে এখন সেখানে জেলা বিএনপির বিতর্কিত নেতা গিয়াস উদ্দিন এখন দলের মনোনয়ন পেতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ৫ আগষ্ট পরবর্তী তার ছেলে সাদরিলের অপকর্মে পুরো জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে দেয় দলের হাইকমান্ড। এরপরও থেমে নেই তাদের অপকর্ম, দখল, চাঁদাবাজি। আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টি আবার আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে আসা এই নেতাকে অনেকে পল্টিবাজ হিসেবেই চিনেন। বিএনপিতে গণতন্ত্র নাই, বস্তাভরা টাকা দিলেই মনোনয়ন পাওয়া যায় এমন বক্তব্য দিয়ে গিয়াসউদ্দিন দলকে বিব্রত করলেও অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর বালু লুটের ডন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম ও আনিসুল হক।
বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে নির্বিঘেœ ব্যবসা করায় তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। আন্দোলনের সময়ে নানা অজুহাতে বিদেশে চলে যেত। ৫ আগস্টের পরে যাদুকাটা নদীর বালুখেকো সিন্ডিকেটের প্রধান নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শাহ রুবেল আহমদকে কব্জা করে বালুমহাল নিজের হাতে তুলে নেন কামরুল ও আনিসুল বাহিনী। রুবেল আহমদ আবার পুলিশের কর্মকর্তা ডিবি হারুনের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। ৫ আগষ্টের পর অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে সুনামগঞ্জে কামরুল ও আনিসুল গ্রুপের ওপর ভর করে রুবেল। এর মাধ্যমে বালুমহালের ব্যবসার পাশাপাশি মেঘালয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ নেন রুবেল। ৫ আগষ্টের পরে তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া বর্ডার, চারাগাঁও বর্ডার, বাগলী বর্ডার নিয়ন্ত্রণে নেন কামরুল ও আনিসুল। মেঘালয় বর্ডারে চাঁদাবাজি করে প্রতিদিন। এছাড়াও তাহিরপুর উপজেলার ডাম্পের বাজার খেয়াঘাট টুল টেক্স, শ্রীপুর বাজার টুল টেক্স, বাদাঘাট বাজার থেকে কামরুল ও আনিসুল গ্রুপের নামে চাঁদা তুলে কোটি কোটি টাকা। কামরুলের নামে নিয়মিত চাঁদার কারণে অতিষ্ঠ তাহিরপুর উপজেলার ব্যবসায়ী শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ। কৃষকদল নেতা লিংকন জানান, তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীর কোটি কোটি টাকার বালু লুটপাটের তথ্য সেনাবাহিনীকে জানানোর কারণে কামরুল গ্রুপের সদস্যরা আমাকে আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, এদেরকে এখনো দমাতে না পারলে আগামী নির্বাচনে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ঘুরে যেতে পারে। এতে ফল বিপর্যয় অবশ্যম্ভ্যাবী।
সারা দেশের মতো ঢাকা মহানগরেও এ রকম চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন দায়িত্বশীল নেতারা। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ জমা হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজের বিরুদ্ধে। আনোয়ার হোসেন নামের একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ অভিযোগ দেন। তিনি নিজেকে বিএনপির কর্মী পরিচয় দিয়ে অভিযোগ করেন, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে যুবলীগ নেতা রিপন গংরা তার আদাবরের শাহীন জুয়েলার্স থেকে ৫০ লাখ টাকার স্বর্ণ লুট করার পাশাপাশি নগদ এক লাখ টাকা নিয়ে যায়। এখন ওই রিপন গং সাজ্জাদুল মিরাজের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে এবং তার ছত্রছায়ায় তার কাছে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা না দেয়ায় যুবলীগের ওই সন্ত্রাসী গ্রুপ তার বাড়ির বিদ্যুতের মিটার খুলে নিয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিলে থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করলেও সাজ্জাদুল মিরাজ তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি কখনো কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। ভবিষ্যতেও দিবে না। কোনো অপকর্মকারীর স্থান বিএনপিতে হবে না।