পাট গবেষণায় আওয়ামী আমলে দলীয় কোটা ও অর্থের বিনিময়ে শতাধিক নিয়োগ

নতুন পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়েও প্রশ্ন; নিয়োগ বাণিজ্যের পুরনো ছক

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তখনকার মন্ত্রীর দফতর ও মহাপরিচালককে ম্যানেজ করে এই নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে পাট গবেষণায় চাউর আছে।

কাওসার আজম
Printed Edition

ড. ফারহানা আক্তার। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০২২ সালে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আমলের সর্বশেষ মহাপরিচালক (ডিজি) ড. আব্দুল আউয়ালের সময় আট জনকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়; তাদেরই একজন ফারহানা। ২০২১ সালের জুলাই মাসের বিজেআরআই-এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার যোগ্যতা উল্লেখ করা হয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডিসহ দুই বছরের অভিজ্ঞতা, অথবা বিএসসি (কৃষি)/বিএসসি (টেক)/এমএস/এমএসসি-সহ পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। তিনটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধের প্রকাশনা অগ্রাধিকারযোগ্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষি-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একটি প্রকল্পের নিউট্রিশিয়ানের (পুষ্টি) ওপর কাজ করার অভিজ্ঞতা দেখিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। বিএলআরআই’র যে প্রকল্পের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে ফারহানা চাকরি পেয়েছেন, ওই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) তার স্বামী ড. সাজেদুল করিম। স্বামীর কাছে অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে বিজেআরআইতে চাকরিতে ঢুকেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তখনকার মন্ত্রীর দফতর ও মহাপরিচালককে ম্যানেজ করে এই নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে পাট গবেষণায় চাউর আছে। যদিও ড. ফারহানা আক্তার দাবি করেছেন যোগ্যতার আলোকেই তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। কোনো লেনদেন করেননি তিনি।

জানা যায়, ড. আব্দুল আউয়ালকে ২০২২ সালের ৩০ জুন ডিজি নিয়োগ দেন তখনকার কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর বেশ কিছুদিন পরেও তিনি বিজেআরআই’র ডিজি ছিলেন। নিয়োগের দুই মাস পার হতেই ৩ আগস্ট ২০ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকটি পদে মোট ৩৯ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এ নিয়োগ নিয়ে তখন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কৃষি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মতিয়া চৌধুরী বরাবর অভিযোগ দেয়া হয়।

অভিযোগসূত্রে জানা যায়, বিগত ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অভিনব কায়দায় অনিয়মের অভিযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, বিজেআরআই’র মহাপরিচালক ড. আব্দুল আউয়াল এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বিপ্লব বিশ্বাস (যুগ্ম সচিব) যৌথ প্রযোজনায় এই নিয়োগে ন্যাক্কারজনকভাবে দুর্নীতি হয়েছে। যার কিছু নমুনাও চিঠিতে বর্ণনা করা হয়। ডিজি এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি মিলিতভাবে তাদের প্রি-সিলেক্টেড ব্যক্তিদের আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেছে। ৮ অক্টোবর, ২০২২ইং সকালে ১ ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এদিনই রাত ১০টায় ফলাফল প্রকাশিত হয়। এতে ১১৪ জনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। তবে, পরের দিন ৯ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে আরেকজনকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে ১১৫ জনের সংশোধিত ফলাফল প্রকাশিত হয়। সংশোধিত ফলাফল শিটে ১১০৬১৯৯ রোল নম্বর অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো অভিযোগে আরো বলা হয়, ১১৫ জনের মধ্যে ২০ জনের ফলাফল ৫১ থেকে ৬০ এর মধ্যে। বাকিদের মধ্যে ৩১ ৩৬-৪৫ নম্বর পান তিনজন, ৩১-৩৫ নম্বর পান ৪০ জন। অভিযোগে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় ৫১-৬০ নম্বর প্রাপ্ত ২০ জনই নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কারণ, ৪০ নম্বর পাওয়া প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ১৫ নম্বর পেলেও তাদের সমান হন না। এই নিয়োগে চার কোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী হিসেবে এই অনিয়ম/দুর্নীতি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু, তখন বিষয়টি আর আগায়নি বলে জানা যায়।

শুধু যে, আব্দুল আউয়ালের আমলেই নিয়োগে এমন অনিয়ম, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে তা নয়। ফ্যাসিস্টের ১৫ বছরে শত শত নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম/দুর্র্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর এসব নিয়োগবাণিজ্য খতিয়ে দেখার দাবি উঠলেও সে পথে হাটেনি গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সময়ের নিয়োগবাণিজ্যের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত করলেই দলীয় বিবেচনায় ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগবাণিজ্যের বিষয়টি প্রমাণ পাওয়া যাবে।

নতুন পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়েও প্রশ্ন

ফ্যাসিস্ট আমলের শেষ দিকে মহাপরিচালক আব্দুল আউয়াল দু’টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ৭ মে, ২০২৪ তারিখে প্রধান বৈজ্ঞানিক পদে দুইজন,ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে তিনজন স্থায়ী এবং একজন অস্থায়ী; ২ জুন ২০২৪ তারিখে ১৪টি পদে ৪৯ জন এবং ১২ জুন তারিখে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে ১২ জন স্থায়ী ও একজন অস্থায়ীভাবে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কিছুদিন পর আউয়ালের চেয়ারে বসেন ড. নার্গীস আক্তার। সিনিয়রকে ডিঙিয়ে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তাকে মহাপরিচালক নিয়োগ প্রদানের পর বিতর্ক তৈরি হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক আগের দিন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সরাসরি রাস্তায় ফেস্টুন নিয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সাথে দাঁড়ানো এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পোস্টার সাঁটানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।

বিগত সময়ে প্রকাশিত তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মোট ৬৮ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি স্থগিত করে গত ৩ ও ৬ আগস্ট তিনটি পৃথক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিজেআরআই। পুনঃবিজ্ঞপ্তিতে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে তিন জনের পরিবর্তে ছয় জন (স্থায়ী) এবং অন্যান্য ১৪টি পদে ৪৯ জনের পরিবর্তে ৫২ জনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একইসাথে নতুন করে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে একজন এবং অডিটর পদে একজনকে যুক্ত করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে ১৩ জনের বিজ্ঞপ্তি বহাল রাখা হয়। এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক (প্রশাসন-চলতি দায়িত্ব) মো: জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে বিগত ১৬ বছরে মহাপরিচালকদের সাথে হাত মিলিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। অতীতে যারাই মহাপরিচালক হয়েছেন, তাদের কাছের লোক হয়েছেন তিনি। আবার ডিজি পদ থেকে সরে যাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধেই জাহাঙ্গীর হোসেন বিষোদগার করেছেন। নতুন যিনি ডিজি হন ফের তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। এমনটাই অভিযোগ বিজেআরআই’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী ডিজি আব্দুল আউয়ালের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীর এখন বর্তমান মহাপরিচালক ড. নার্গীস আক্তার ও পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. ইয়ারউদ্দীনের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকায় প্রশাসনের সবকিছু জাহাঙ্গীর হোসেনের কব্জায় রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নতুন পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আগের মতোই নিয়োগ সিন্ডিকেট গড়ে তোলার আয়োজন চলছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে।