বায়তুল মোকাররম মার্কেটে বহাল তবিয়তে আওয়ামী দখলবাজরা

দোকান ফিরে পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বৃদ্ধ আনোয়ার আলী

খালিদ সাইফুল্লাহ
Printed Edition

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মার্কেটে আওয়ামী লীগ আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দু’টিসহ সাতটি দোকান দখল করে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব গাজী ও তার ভাই মার্কেটের সহসভাপতি নাসির উদ্দিন গাজী। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর নিজেদের দু’টি দোকান উদ্ধার করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন; কিন্তু ব্যক্তিমালিকনাধীন পাঁচটি দোকান বুঝে পাননি বয়োবৃদ্ধ মীর আনোয়ার আলী। দোকান ফিরে পেতে এখনো দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। জানা যায়, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা সোহরাব গাজী আরো অনেকের দোকান দখল করে নেন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মার্কেটের সবাই। এ জন্য ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর জনতার রুদ্ররোষের শিকার হয়ে প্রাণ হারান সোহরাব গাজী; কিন্তু এখন তার ভাই নাসির উদ্দিন গাজী বহাল তবিয়তে থেকে দখলবাজি অব্যাহত রেখেছে।

জানা যায়, জাপান প্রবাসী মীর আনোয়ার আলী ১৯৭৮ সালে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ৩ নম্বর গোডাউন ক্রয় করে ভোগদখল করে আসছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নসের ১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবরের এক সিদ্ধান্তের আলোকে ২০০০ সালের ১৪ মার্চ শর্তসাপেক্ষে ওই গোডাউনকে সাতটি দোকানে রূপান্তর করা হয়। শর্ত অনুসারে মীর আনোয়ার আলী পাঁচটি দোকানের এবং মার্কেট কর্তৃপক্ষ দু’টি দোকানের মালিক হয়। মীর আনোয়ার আলীর সব সন্তান উচ্চশিক্ষিত ও প্রবাসী হওয়ায় দোকানগুলো দেখাশুনা করার জন্য ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর সোহরাব গাজী নামে এক ব্যক্তিকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সোহরাব গাজী আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে দোর্দণ্ড প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার প্রভাবে তার ভাই নাসির উদ্দীন গাজীকে বানান বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সহসভাপতি।

সোহরাব ক্ষমতার দাপট ও মার্কেট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ইফার দু’টি দোকানও দখল করে ২০২৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোগদখল করেন।

সোহরাব, তার বাহিনী ও তার ভাইদের দাপটে মার্কেটের সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে মার্কেট কর্তৃপক্ষ সবাই অসহায় হয়ে পড়ে। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। মার্কেটে এলে মীর আনোয়ার আলীকে ঠ্যাং ভেঙে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে মার্কেটে আসতে নিষেধ করেন। এ অবস্থায় ২০২৩ সালে আনোয়ার আলী পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করে দোকান দখলে যেতে চাইলে সোহরাব-নাসিরুদ্দিন গাজী গং আবারো হুমকি দিলে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গণপিটুনির শিকার হন সোহরাব গাজী। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।

সম্প্রতি বয়োবৃদ্ধ মীর আনোয়ার আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের কাছে দোকান উদ্ধারে আবেদন করেন। ইফা মহাপরিচালক বিষয়টি দেখার জন্য মার্কেট বিভাগের পরিচালককে দায়িত্ব দেন। ইফা সূত্রে জানা যায়, তিনি উভয় পক্ষকে নোটিশ পাঠিয়ে শুনানি করেন। শুনানিকালে সোহরাবের ভাই নাসিরুদ্দিন গাজীকে দোকান দখলে কিভাবে আছেন জানতে চাইলে কয়েকদিন সময় প্রার্থনা করেন। তারা কয়েকদিন পরে নোটারি পাবলিকের জাল কাগজ তৈরি করে দাবি করেন মীর আনোয়ার আলী ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি গ্রহীতা সোহরাব গাজীর স্ত্রী সায়লা আক্তারের কাছে বিক্রি করেছেন। শুনানিতে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি ২০১২ সালে সোহরাব গাজীর স্ত্রী সায়লার কাছে বিক্রি করে থাকে তবে কেন সোহরাব গাজী পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব পাওনা মীর আনোয়ার আলীর নামে পরিশোধ করেছেন। কেন সোহরাব গাজী বা মীর আনোয়ার আলী বা সায়লা কেউ নোটিশ দিয়ে না ডাকা পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর সায়লার নামে দোকান হস্তান্তরের আবেদন করেননি, কেন সোহরাব ২০২৩ সালের ৩০ মে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করার পরও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (২.১০.২০২৪) এক বছরের অধিক সময় পেয়েও তার স্ত্রীর নামে কেনার দাবি করেননি। তারা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তা ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দু’টি দোকান কিভাবে দখলে আছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলেও কোনো জবাব দিতে পারেননি তারা। এ জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের পাওনা দু’টি দোকান গত ১০ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার করে দখলে নিয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধ আনোয়ার আলীর প্রবাস জীবনের ঘামের টাকায় কেনা দোকানগুলো আজও উদ্ধার হয়নি। এখনো নাসির উদ্দিন গাজীরা তার দোকানগুলো দখল করে ভোগদখল করে আসছে। আনোয়ার আলী বারবার ইফাতে ধরনা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না। জানা যায়, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি সোহরাব গাজীকে জনতা গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করলেও এখনো তার ভাই নাসির উদ্দিন গাজী বয়োবৃদ্ধ মীর আনোয়ার আলী ছাড়াও আরো অনেকের দোকান এখনো জবরদখল করে রেখেছে। কিন্তু ইফার পক্ষ থেকে সেগুলো উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, সোহরাব গাজী ও নাসির উদ্দিন গাজীরা এতদিন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আনোয়ার আলীর দোকান দখল করে রেখেছিল। এমনকি তারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দু’টি দোকানও দখল করে রেখেছিল। আমরা ফাউন্ডেশনের দু’টি দোকান ইতোমধ্যে উদ্ধার করেছি। আনোয়ার আলী আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। আমরা শুনানি করে দেখেছি সোহরাব গাজীরা জাল দলিল করে ভোগদখল করছে। এ জন্য তাদের দোকান উদ্ধারেরও চেষ্টা চলছে।

বৃদ্ধ আনোয়ার আলীর শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর আগে তিনি তার সম্পদের দখল ফিরে পেতে চান। এ বিষয়ে ধর্ম উপদেষ্টা, ধর্ম সচিবের হস্তক্ষেপসহ সরকারের সহোযোগিতা চেয়েছেন তিনি।