দক্ষতার সাথেই বাফুফে চালাচ্ছেন তাবিথ

রফিকুল হায়দার ফরহাদ
Printed Edition

কাজী সালাহউদ্দিনের ১৬ বছরের বাফুফে শাসনের অবসান। গত বছর ২৬ অক্টোবর বাফুফের নির্বাচনে আর সভাপতি পদে নির্বাচন করেননি সাবেক এই তারকা ফুটবলার। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি নিজেই সভাপতি পদে নির্বাচন না করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ফলে রেকর্ড ভোটেই সভাপতি নির্বাচিত হন তাবিথ আউয়াল। ক্রীড়াঙ্গনে আগেই পরিচিত তাবিথ। বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী একই সাথে সাবেক ফুটবলার। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, পেশাদার ফুটবল লিগে খেলেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনেই ক্লাব গড়েছেন। সেই ক্লাবকে দেশের শীর্ষপর্যায়ে খেলিয়েছেন। পরবতীতে দুই দফা বাফুফের সহসভাপতি হয়েছেন। এরপরও অনেকের মনে সন্দেহ ছিল তাবিথ পারবেন কি না বাফুফের মতো দেশের অন্যতম এই ফেডারেশন পরিচালনা করতে। অথচ ঠিকই দক্ষতার সাথে পরিচলনা করছেন ফেডারেশন। বরং কাজের পরিধি আরো বৃদ্ধি করেছেন। শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছে বাফুফের কার্যক্রম। ফেডারেশনের কাউন্সিলরও নন তাদেরকে বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন। এতে নতুন নতুন মেধা ফেডারেশনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।

তাবিথ আউয়াল সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সাবিনা খাতুনদের এই শিরোপা ধরে রাখার পুরো কৃতিত্ব অবশ্য কাজী সালাহউদ্দিনের কমিটির। এরপর বাংলাদেশ সিনিয়র নারী দল এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার ছাড়পত্র অর্জন করে। পরবর্তীতে অনূর্ধ্ব-২০ নারী দল সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই ধারায় তারা লাওসের মাঠে লাওস ও পূর্ব তিমুরকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো অর্জন করে অনূর্ধ্ব-২০ এএফসির নারী ফুটবলে চূড়ান্ত পর্বে খেলার ছাড়পত্র। পুরুষ সিনিয়র জাতীয় দলের এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে দুই অ্যাওয়ে ম্যাচে ড্রটা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ দলে ইংল্যান্ড প্রবাসী হামজা চৌধুরীর খেলার প্রক্রিয়াটা দুই বছর আগ থেকে শুরু হয়। বাফুফের গত কমিটির সেই কার্যক্রমের সুফলই ভোগ করছে তাবিথ আউয়ালের বর্তমান কমিটি। হামজা আসার পরপরই ইতালি থেকে ফাহামিদুল ইসলাম, কানাডা থেকে শমিত শোম এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে জায়ান আহমেদরা বাংলাদেশে এসে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে তোলেন। জায়ান জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন বাফুফের বিদেশী ফুটবলারদের ট্রায়ালের কর্মসূচি থেকে। ৫০ জনের মতো প্রবাসী ফুটবলারকে ঢাকায় ডেকে এনে তাদের তিন দিনব্যাপী ট্রায়ালে ডাকা। সেখান থেকে জায়ান আহমেদ পান সবুজ সঙ্কেত। এ ছাড়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ইতালি প্রবাসী আবদুল কাদির, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফারজাদ আহমেদরা ডাক পান। কাদির এক ম্যাচ খেললেও ফারজাদের সেই সুযোগই হয়নি।

তাবিথ আউয়াল বাফুফের সভাপতির পাশাপাশি ন্যাশনাল টিমস কমিটিরও চেয়ারম্যান। তার সময়ে নারী ফুটবল দল সাফল্য পেলেও ব্যর্থ পুরুষ ফুটবল দল। তা সিনিয়র-জুনিয়র সব লেভেলেই। বড় আশা ছিল সিনিয়র জাতীয় দলকে নিয়ে। এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে ‘সি’ গ্রুপে ছিল ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই থাকা প্রতিপক্ষরা। কিন্তু কোচ, খেলোয়াড় সবার ভুলের খেসারতেই বাছাই পর্বের প্রথম ছয় ম্যাচের কোনোটিতেই জিততে না পারা। যেখানে হামজা চৌধুরী, শমিত শোমের মতো বিদেশী লিগে খেলা ফুটবলাররা ছিলেন। ভারতের বিপক্ষে গোল মিসের খেসারত দিয়ে ড্র করা। হংকং ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হোমে ডিফেন্ডার আর গোলরক্ষকদের ভুলের যোগফলে হার। পরে হংকং গিয়ে সেখানেও জিততে না পারা। যদিও শেষ পর্যন্ত ড্র করেই দেশে ফিরতে পেরেছে। অনূর্ধ্ব-২৩ দলও পারেনি এএফসি আসরের ফাইনাল রাউন্ডে উঠতে। যদিও শেষ ম্যাচে সিঙ্গাপুরকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয়া। অনূর্ধ্ব-২০ পুরুষ দলের মতো অনূর্ধ্ব-১৭ পুরুষ দলও সাফে ফাইনালে হেরে শিরোপা জিততে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার মিছিলে ছিল অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দলও। তারা সাফে হতে পারেনি চ্যাম্পিয়ন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ কোয়ালিফাইয়ের সুযোগ হারায়।

তবে সাংগঠনিকভাবে দারুণ সফলতা দেখাচ্ছেন তাবিথ। অতীতের রেওয়াজ ভেঙে বাফুফের কাউন্সিলর নন এমন ব্যক্তিদের বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন। তারাও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় দলের জন্য স্পন্সররা লাইন ধরছে। যেখানে আগে স্পন্সরই মিলত না। আর এটা সহজ হয়েছে হামজা চৌধুরীর আগমনের পর। বাংলাদেশ দলের জার্সি এখন সর্বসাধারণের গায়ে। ক্রিকেট মাঠেও এখন ফুটবলের জার্সিতে দর্শকদের উপস্থিতি। হামজা দেশে আসার পর বাংলাদেশ দলের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ ছিল ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপের বাছাই। সেই ম্যাচ দেখতে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা মাঠে হাজির হন। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল স্ক্রিনে দেখানো হয়েছিল খেলা। তা হয়েছিল বাফুফের ব্র্যান্ডিংয়ের কারণেই।

বাফুফের ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগও দারুণভাবে সফল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাফুফের গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে বেড়েছে বহুগুণ।

তাবিথ আউয়াল দায়িত্ব নেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই নারী ফুটবলারদের বিদ্রোহ। কোচ পিটার বাটলারের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেন ১৮ নারী ফুটবলার। সেই সমস্যা খুবই দক্ষতার সাথে সামলিয়েছেন তাবিথ আউয়াল। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়াদের দলে আর ডাকেননি কোচ পিটার বাটলার। সেই সাথে কোচ বাটলারের ওপর আস্থা রেখেছে বাফুফে। সাবিনা, মাছুরা, কৃষ্ণা, সানজিদা, সুমাইয়াদের ছাড়াই বাংলাদেশ দল এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। এশিয়ান ফুটসাল বাছাই খেলতে মালয়েশিয়া গেছে বাংলাদেশ দল। অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করেছে বাফুফে। তবে মাঠ সঙ্কটে মহানগরীর ফুটবল লিগ আয়োজনে বিলম্ব হয়েছে। অবশ্য ১৫ নভেম্বর শুরু হচ্ছে সিনিয়র ডিভিশন লিগ। আর নারী ফুটবল লিগ ১৫ ডিসেম্বর শুরু হওয়ার কথা। তৃণমূল ফুটবলে ব্যাপক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এএফসি প্রেসিডেন্টস রিকনাইজেশনের ব্রোঞ্জ পদক পায় বাফুফে। এই বাফুফের দক্ষতায় স্বীকৃত ফুটবল একাডেমি এখন ৩২০টি।

তাবিথ আউয়াল দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ফিফাকে বাধ্য করেছেন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। জাতীয় দলই শুধু বিদেশের মাঠে অনুশীলন ম্যাচ খেলছে না। অনূর্ধ্ব-২৩ পুরুষ দলের মতো অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দলও বিদেশের মাঠে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পারছে। অতীতের মতো টাকার অভাবে কোনো জাতীয় দলের বিদেশে খেলা বাতিল হয়নি। এই সাফল্যগুলোর মধ্যে এখনো সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী দলকে ঘোষিত দেড় কোটি টাকার পুরস্কার দিতে না পারাটা বেমানানই। আর হামজাদের উপস্থিতিতে জাতীয় দল যদি এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করত তাহলে অনেকটা পূর্ণ হতো গত এক বছরে বাফুফের সফল মিশন। সেই সাথে এখনো স্পন্সর ছাড়াই চলছে বাংলাদেশ ফুটবল লিগ ও ফেডারেশন কাপ।