ইসলামের দৃষ্টিতে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা

Printed Edition
ইসলামের দৃষ্টিতে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা
ইসলামের দৃষ্টিতে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা

মো: রায়হান হোসাইন

প্রাচীনকাল থেকে একবিংশ শতাব্দী, মানুষ শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতের জন্য কঠোর পরিশ্রম কিংবা পদ্ধতিগত বিভিন্ন কসরত করে আসছে। শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি আধুনিককালে মানসিক সুস্থতার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। অতীতে বিভিন্ন ধরনের শরীরচর্চার মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা অর্জন ছিল মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন গ্রিসে শরীরচর্চা বা শারীরিক শিক্ষার আবির্ভাব হয়। জ্ঞানবিকাশ কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে শরীরের সুস্থতার কোনো বিকল্প নেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন মহান দার্শনিক প্লেটো। প্লেটোর মতে, কোনো ব্যক্তির শারীরিক সুস্থতা ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সম্ভব নয়। তার মতে, অলসতার কারণে আমাদের সুন্দর শরীরও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে পদ্ধতিগত শরীরচর্চা আমাদের শরীরকে সুস্থই রাখে না; বরং শরীরকে সংরক্ষণও করে। ফলে প্রাচীনকালে শরীরচর্চা পরিণত হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। তৎকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শরীরচর্চা। এ ছাড়া সেই সময়ে বিভিন্ন ধরনের শরীরচর্চা ছিল বিনোদনের মাধ্যমও বটে। এতে করে আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, সে সময় যেসব দেশ পদ্ধতিগত শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেছে সেসব দেশ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রেও এগিয়েছিল। কেননা, খেলাধুলা শুধু আমাদের বিনোদনের মাধ্যম কিংবা শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে না; বরং আমাদের মানসিক সুস্থতাও নির্ণয় করে। ফলে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এরই ধারাবাহিকতায় আধুনিককালেও শরীরচর্চা ও খেলাধুলার পরিসর বৃদ্ধি পেয়ে পরিণত হয়েছে শারীরিক শিক্ষার মতো পরিপূর্ণ পাঠ্য বিষয়ে। পাশাপাশি পেশাগত জায়গায় তৈরি হয়েছে একটি বৃহৎ সেক্টরের। যে সেক্টরে লাখ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত। ফলে প্রয়োজন হয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির, প্রয়োজন হয়েছে উন্নত প্রযুক্তির। এমতাবস্থায় শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে শারীরিক শিক্ষা বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অন্য দিকে বর্তমানে খেলাধুলায় শুধু পুরুষরা নয়; বরং নারীরাও অংশগ্রহণ করছে সমানতালে। যার কারণে এর সাথে আরো একটি বিষয় জড়িয়ে পড়ছে আর তা হলো ধর্ম। বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে আমরা যারা ইসলাম ধর্মচর্চা করি তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিভিন্ন রকম সঙ্কোচ ও সঙ্কট। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে আমাদের ধর্ম পালনের চেয়ে ধর্মীয় আবেগ বেশি। বিশেষত আমাদের আলেম সমাজের কিছু অংশ ফতোয়া দেন খেলাধুলা হারাম। আবার কেউ কেউ খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক ব্যাপার, পোশাক, জুয়া ইত্যাদির কারণে খেলাধুলাবিরোধী ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তবে ইসলামেও আছে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা নিয়ে আছে সুস্পষ্ট হাদিস ও ইতিহাস। শারীরিক শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু হলো ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ। এ ক্ষেত্রে ইসলামেও ব্যক্তির বিকাশজনিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে আমরা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি লক্ষ করি। এ ক্ষেত্রে খেলাধুলা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যায়। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার লক্ষ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ সা: একাধিক সুন্দর উদাহরণ রেখে গেছেন। এ ছাড়া সাহাবিদের যুগেও খেলাধুলার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। যার মধ্যে দৌড়, সাঁতার, ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজি, কুস্তি, মল্লযুদ্ধ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

শুরুতেই উল্লেখ করা যায়, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত-রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও উত্তম, দুর্বল মুমিনের চেয়ে।’ (মুসলিম)

দৌড় : এ বিষয়ে হজরত সালামা ইবনে আকওয়া রা: বলেন, একজন আনসারি সাহাবি দৌড়ে খুবই পারদর্শী ছিলেন। দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ তাকে হারাতে পারত না। একদিন তিনি ঘোষণা করলেন, আমার সাথে কি দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে কেউ প্রস্তুত আছে কি? আমি রাসূল সা:-এর কাছে এ ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। এ প্রতিযোগিতায় আমি জয়ী হলাম। (মুসলিম)

তীর নিক্ষেপ : হাদিসে তীর নিক্ষেপের কথা গুরুত্বের সাথে এসেছে। নবী সা: তীর নিক্ষেপকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘মহান আল্লাহ একটি তীরের ওছিলায় তিনজন লোলকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তীর নির্মাতা, যে নির্মাণকালে কল্যাণের আশা করেছে, তীর নিক্ষেপকারী এবং তা নিক্ষেপে সাহায্যকারী।’ তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা তীরন্দাজি করো ও ঘোড়দৌড় শিক্ষা করো। তবে তোমাদের ঘোড়দৌড় শেখার তুলনায় তীরন্দাজি শেখা আমার কাছে বেশি পছন্দনীয়।’ (তিরমিজি)

ঘৌড়দৌড় : বুখারিতে বর্ণিত আছে, মহানবী মুহাম্মদ সা: তৎকালীন সময়ে নিজে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। এ বিষয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত-নবী সা: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছেন। যার দূরত্ব ছিল হাফয়া থেকে শুরু হয়ে সানিয়াতুলবিদা পর্যন্ত। বর্ণনাকারী বলেন, আমি মুসা রা:-কে বললাম, এর দূরত্ব কত হবে? তিনি বললেন, ছয় বা সাত মাইল। এ ছাড়া প্রশিক্ষণহীন ঘোড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হতো সানিয়াতুলবিদা থেকে এবং শেষ হতো বনু জুরাইকের মসজিদের কাছে। আমি বললাম, এর মধ্যে দূরত্ব কতটুকু? তিনি বললেন, এক মাইল বা তার কাছাকাছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: নিজেও এই প্রতিযোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (বুখারি)

সাঁতার : নবী সা: সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক এমন জিনিস, যাতে মহান আল্লাহর স্মরণ নেই তা অর্থহীন, তবে চারটি বিষয় ছাড়া। তা হলো- দুই লক্ষ্যের মাঝে চলা, ঘোড়াতে প্রশিক্ষণ দেয়া, স্ত্রীর সাথে হাসি কৌতুক করা ও সাঁতার শেখা। (সুনানে কুবরালিল-নাসায়ি)

মল্লযুদ্ধ : ইসলামের সোনালি যুগে একটি বহুল প্রচলিত খেলা ছিল মল্লযুদ্ধ। এমনকি দ্বীন প্রচারের স্বার্থে মহানবী সা: নিজেও একবার মল্লøযুদ্ধে অংশ নেন। মক্কার একজন বিখ্যাত মল্লযোদ্ধা ছিল রুকানা ইবনে ইয়াজিদ। একদিন নবী সা: তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন নবী সা: তাকে বলেন, আমি যদি মল্লযুদ্ধে তোমাকে পরাজিত করি, তবে কি তুমি মহান আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে? রুকানা তাতে সম্মত হয়। এরপর নবী সা: তাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম)

তবে খেলাধুলা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি রয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো যেমন- ১. আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না হওয়া এবং শরিয়তের মৌলিক বিধিবিধান পালনে বাধা না থাকা। ২. আকিদা বা বিশ্বাসগত ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা। ৩. জুয়া, বাজি ও শিরকের উপকরণ না থাকা। ৪. পর্দার বিধান ও শালীনতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

সুতরাং পরিশেষ বলা যায়, ইসলাম ধর্মে শারীরিক শিক্ষা কিংবা খেলাধুলাকে হারাম করেনি; বরং কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যা মানুষের জন্য কল্যাণকর তা গ্রহণ করা এবং যা ক্ষতিকর তা বর্জন করার মধ্য দিয়ে ইসলামে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা সুস্থ ধারার বিনোদনের ব্যবস্থাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।

লেখক : প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল।