ফ্যাসিবাদের বারবার ফিরে আসার ব্যর্থ চেষ্টা

ফ্যাসিবাদ শুধু সরকারের পতনে শেষ হয়নি। গেল এক বছরে বহুবার নানান ছদ্মবেশে, নানা প্রলোভন ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তা ফিরে আসার চেষ্টা করেছে। তবে জনগণের সচেতনতা, শিক্ষার্থী-জনতার ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তায় সেই চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition

৫ আগস্ট, ২০২৪ ছাত্র-জনতার দুর্নিবার গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদশকেরও বেশি সময় ধরে চলা নিপীড়নমূলক শাসনের অবসান হয় এই দিনে। পতন ঘটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের, যার পরিণতিতে দেশ প্রবেশ করে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে।

কিন্তু ফ্যাসিবাদ শুধু সরকারের পতনে শেষ হয়নি। গেল এক বছরে বহুবার নানান ছদ্মবেশে, নানা প্রলোভন ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তা ফিরে আসার চেষ্টা করেছে। তবে জনগণের সচেতনতা, শিক্ষার্থী-জনতার ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তায় সেই চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।

জুডিশিয়াল ক্যু থেকে ফিরে আসা

আওয়ামী সরকারের পতনের তিন দিন পর, ৮ আগস্ট, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে-১১ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ফুল কোর্ট সভা ডাকেন, যা শিক্ষার্থীদের ভাষায় ছিল “জুডিশিয়াল ক্যু”-এর চেষ্টা।

হাইকোর্ট ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা সেই প্রচেষ্টা প্রতিহত করে। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি, আর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা।

আনসার বিদ্রোহ ও ছদ্মবেশী আগ্রাসন

২৩ আগস্ট আনসার সদস্যদের বিদ্রোহ এবং ২৫ আগস্ট সচিবালয়ের গেট ভেঙে হামলা ছিল ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের আরেকটি বড় প্রয়াস। তবে এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছদ্মবেশী সম্পৃক্ততা দ্রুতই প্রকাশ্যে আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মুখে আনসারদের পিছু হটতে হয়।

এর আগে ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া গ্রামপুলিশ সদস্যদের আন্দোলনও সড়ক অবরোধ এবং সচিবালয় ঘেরাওয়ের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করেছিল। এসব আন্দোলনের পেছনে গোপনে ছিল পরাজিত সরকারের পরিকল্পিত মদদ ও উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা।

সাত কলেজের আন্দোলন ও গার্মেন্ট ষড়যন্ত্র

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও গোপনে সরকার পতনের নকশার অংশ ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিসমূহ আংশিক মেনে নেয়ার কৌশলে সেই ষড়যন্ত্র প্রতিহত হয়।

এরপর গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন ছিল আরো সুগঠিত চক্রান্তের অংশ। ঈদের আগে বকেয়া পরিশোধ, বোনাস ইত্যাদি দাবিকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামনে তিন দিনের অবস্থান কর্মসূচিতে নামে শ্রমিকরা। ২৪-২৫ মার্চের সংঘর্ষে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়, যার পেছনে শ্রমিক লীগের সক্রিয় ইন্ধন পাওয়া যায়। সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়ায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।

আমলাতন্ত্রের প্রতিরোধ

মে মাসে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনও ছিল পতিত আমলাতান্ত্রিক শক্তির সর্বশেষ প্রতিরোধ। অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আমলারা সরব হয়। প্রথমে নমনীয় অবস্থান দেখালেও সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আন্দোলন থেমে যায়।

এই ঘটনাগুলো ফ্যাসিবাদী চেতনার পুনরুজ্জীবনের নমুনা। প্রতিবারই গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও জনগণের জাগরণ এই শক্তিকে প্রতিহত করেছে।

সাম্প্রতিক সঙ্কেত : আবার ষড়যন্ত্র?

গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে আবারো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। গোয়েন্দা তথ্য মতে, এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। বরং দিল্লিতে আত্মগোপনে থাকা শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পরিকল্পনার ফলাফল হিসেবে এগুলোকে দেখা হচ্ছে।

এই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নে এখনো দেশে সক্রিয় রয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী আমলা, পুলিশ ও নিষিদ্ধ ছাত্র-যুব-শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীরা। অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তারা এখনো সক্রিয়।

জনগণই প্রতিরোধের একমাত্র শক্তি

এক বছর পেরিয়ে এলেও ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তবে শিক্ষার্থী-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, রাজনৈতিক দলগুলোর সতর্কতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তা এখন পর্যন্ত এসব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে।

৫ আগস্ট শুধুই একটি তারিখ নয়, এটি ফ্যাসিবাদ পতনের প্রতীক। আর তাই, প্রতি বছর এই দিনে আমাদের মনে রাখতে হবে- ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে চায়, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জনগণ কখনো তাকে ফিরতে দেবে না।