বাংলাদেশকে হালাল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র বানাতে চায় সরকার

শাহ আলম নূর
Printed Edition
  • হালাল খাদ্যের বাজার ১০ ট্রিলিয়ন ডলার
  • মালয়েশিয়া ও সৌদি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা

বিশ্ববাজারে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের হালাল খাদ্যপণ্য বাণিজ্যে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে উদ্যোগ জোরদার করেছে সরকার। এবং দেশীয় বাজার ও রফতানির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সরকার প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও বৃহৎ ভোক্তাশ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি প্রধান হালাল খাদ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নির্ধারণ করেছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বহুমাত্রিক হালাল অর্থনীতিতে একটি বড় অংশীদার হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বিশ্বের মুসলিম ভোক্তাশ্রেণীকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে থাকা এই বাজার ইতোমধ্যে ৭.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে এবং ওই সময়ের মধ্যে এটি ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশালতায় পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ বাজারকে সামনে রেখে সরকার দেশীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রস্তুত করছে এবং সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ থেকে বিনিয়োগ আনতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী হালাল বাজারের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রতিযোগিতাও তীব্র হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সঠিক সার্টিফিকেশন ছাড়া বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনাময় বাজার হারাতে পারে। ইতোমধ্যে কয়েকটি আমদানিকারক দেশ বাংলাদেশের কাছে আন্তর্জাতিক মানের হালাল সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, হালাল বাজার শুধু খাদ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি গোশত, পানীয়, ওষুধ, প্রসাধনী, পোশাক, এমনকি পর্যটন ও আর্থিক খাতেও বিস্তৃত। তাই আমাদের সুযোগ অনেক বড়। তবে উৎপাদন থেকে রফতানি পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সার্টিফিকেশন না হলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের হালাল শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সঠিক সার্টিফিকেশন ও অনুমোদনের অভাবে আমরা এখনো বাজার ধরতে পারিনি। তিনি বলেন, একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান অল্প পরিমাণ হালাল গোশত রফতানি করছে। কিন্তু এ ধারা বড় আকারে বিস্তার করতে হলে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব বিশ্বে হালাল ভোগ্য পণ্য ও সার্টিফিকেশনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্য দিকে ভারত, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশও হালাল খাদ্য রফতানিতে শীর্ষ অবস্থানে আছে। এমন প্রেক্ষাপটে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে এখানে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম এবং দেশীয় ভোক্তা বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া উপসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী প্রবাসী হালাল পণ্যের সম্ভাব্য বাজার তৈরি করে দিচ্ছে।

কুয়ালালামপুরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ব্যবসায়িক ফোরামে বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, আমরা মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকে বাংলাদেশের হালাল শিল্পে উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক সুযোগ হিসেবে দেখি। মালয়েশিয়া প্রতিযোগিতামূলক সোর্সিং থেকে উপকৃত হবে, আর বাংলাদেশ পাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত সার্টিফিকেশন ও বৈশ্বিক বাজার নেটওয়ার্কের সুবিধা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হালাল রফতানির ক্ষেত্রে সৌদি আরবের শর্ত এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশটির নীতি অনুযায়ী, সৌদি অ্যাক্রেডিটেশন সেন্টার (এসএএসি), সৌদি স্ট্যান্ডার্ডস, মেট্রোলজি অ্যান্ড কোয়ালিটি অর্গানাইজেশন (এসএসিও) এবং সৌদি ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি (এসএফডিএ) থেকে অনুমোদন ছাড়া কোনো দেশ খাদ্য রফতানি করতে পারবে না। একইভাবে, মালয়েশিয়ার জাকিম (জেএকেআইএম) সার্টিফিকেশন ছাড়া সে দেশের বাজারে প্রবেশ করা যাবে না।

সাম্প্রতিক এসএএসি এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে পাবনার বেঙ্গল মিট কারখানা ও মানিকগঞ্জের আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেছে। বেঙ্গল মিটের সিইও এএফএম আসিফ বলেন, সৌদি প্রতিনিধিদল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের কারখানা পরিদর্শন করেছে। আমরা ইতোমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে হালাল সনদ নিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সার্টিফিকেশন বিভাগের উপপরিচালক ড. মো: আবু সালেহ পাটওয়ারী বলেন, সৌদি হালাল সার্টিফিকেশন পাওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা অনলাইনে আবেদন করেছি এবং এর অংশ হিসেবে প্রতিনিধিদল স্থানীয় দু’টি কারখানায় শারীরিক পরিদর্শন করেছে বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, গোশত, খাদ্য, পানীয়, ওষুধ এবং প্রসাধনী এই পাঁচটি খাতের জন্য আবেদন করা হয়েছে। প্রতিনিধিদল সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ইতিবাচক প্রতিবেদন দেয়ার প্রত্যাশা করেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ‘রিভার্স-লিঙ্কেজ প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে, যা বাংলাদেশে সার্টিফিকেশন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও একটি শক্তিশালী হালাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে মাত্র ১০০টি বাংলাদেশী কোম্পানি মালয়েশিয়ার জাকিম থেকে হালাল সার্টিফিকেশন পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংখ্যা যদি দশগুণ বৃদ্ধি করা যায় অথবা একটি নিবেদিত হালাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের রফতানি বহুগুণে বাড়বে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, হালালের ধারণা এখন গোশতের বাইরে সব পণ্যে প্রসারিত হচ্ছে। জাপান, কোরিয়ার মতো অমুসলিম দেশও এই ধারণাকে গ্রহণ করছে। অথচ আমাদের দেশে সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া এখনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতিতে ভুগছে।’

তিনি বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিএসটিআই উভয় প্রতিষ্ঠানকেই সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। তিনি আরো বলেন, সার্টিফিকেশন ফি কমানো এবং বাংলাদেশী হালাল পণ্যের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং করা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক হালাল মেলায় অংশগ্রহণ করতে হবে, যেমন- আগামী সেপ্টেম্বরে তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য হালাল মেলা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক হালাল বাজারে বাংলাদেশ ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হলেও এখনো অনেক পথ বাকি। সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং স্থানীয় শিল্পকে সক্ষম করা ছাড়া এই বহুমাত্রিক বাজারে টেকসই অবস্থান নেয়া সম্ভব হবে না। তবে সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনা ও দ্রুত পদক্ষেপ নিলে ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বৈশ্বিক হালাল বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।