মহিলাসহ ৭৫ কারাগারে চলছে প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান

অভিযোগ পেলেই এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বদলি

শুধু প্রশাসনিক কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে কর্তব্যরত বন্দীদের প্রশাসনিক, বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা, মাদক সেবন ও পাচার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে অপপ্রচারের পাশাপাশি নিজ দায়িত্ব ছেড়ে বন্দীর সাথে খাবার গ্রহণের অভিযোগে গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক কারারক্ষী, সর্বপ্রধান কারারক্ষীকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। কারা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে বেশকিছু দিন ধরেই কারা প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে অনেক কারারক্ষী অনিয়ম করতে সাহস পাচ্ছে না।

মনির হোসেন
Printed Edition

কাশিমপুরের একমাত্র মহিলা কারাগার, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজারসহ দেশের ৭৫টি কারাগারে আটক লাখো বন্দীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট। ‘বন্দী সেবার’ নামে এই সিন্ডিকেটের ‘অন্যতম’ হয়ে কাজ করার অভিযোগ কিছু চিহ্নিত কারারক্ষী, সর্বপ্রধান কারারক্ষী ও রাইটারদের বিরুদ্ধে। গত এক মাসে কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠার পর তাদেরকে কারা মহাপরিদর্শকের নির্দেশে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। এ সময় কারো কারো বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কারা প্রশাসনে যেন কারাবন্দীরা কারাবিধি অনুযায়ী সব বৈধ সুবিধা ভোগ করেন।

কারা অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে জানা গেছে, শুধু প্রশাসনিক কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে কর্তব্যরত বন্দীদের প্রশাসনিক, বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা, মাদক সেবন ও পাচার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে অপপ্রচারের পাশাপাশি নিজ দায়িত্ব ছেড়ে বন্দীর সাথে খাবার গ্রহণের অভিযোগে গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক কারারক্ষী, সর্বপ্রধান কারারক্ষীকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। কারা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে বেশকিছু দিন ধরেই কারা প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে অনেক কারারক্ষী অনিয়ম করতে সাহস পাচ্ছে না।

গত ২৩ নভেম্বর অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে নারায়ণগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও রাজবাড়ী জেলা কারাগারের তিন কারারক্ষীকে বন্দীর সাথে অবৈধ লেনদেনসহ নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক তিনটি কারাগারে বদলি করা হয়। এর মধ্যে বন্দীর আত্মীয়ের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ ও কারা অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের কারারক্ষী আলফাজুর রহমানকে নিলফামরাী জেলা কারাগারে বদলি করা হয়। অপর দিকে মৌলভীবাজার জেলা কারাগারের কারারক্ষী নিখিল ব্যানার্জিকে তথ্য পাচার, বেনামী পত্র লেখা, মাদক সেবন ও সরবরাহ, জামিনবাণিজ্য এবং উসকানিকমূলক কথা বলার অভিযোগে ঝিনাইদাহ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়। একইভাবে রাজবাড়ী জেলা কারাগারের কারারক্ষী মো: রায়হানুল কবিরের বিরুদ্ধে নির্ধারিত পোস্টিং ছেড়ে বন্দীর সাথে খাওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার এবং বেয়াদবি করার অভিযোগ পায় কারা কর্তৃপক্ষ। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পটুয়াখালী জেলা কারাগারে বদলির সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু এই তিন কারারক্ষী নন, সাম্প্রতিক সময়ে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর আরো বেশকিছু কারারক্ষীকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে বদলি করা হয়। এর

গত সপ্তাহে কক্সবাজার জেলা কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, কারা কম্পাউন্ডের ভেতরে দায়িত্বরত কারারক্ষীসহ অন্যান্য পদের রক্ষীরা নিয়মের মধ্যে থেকেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে মূল গেটে থাকা কারারক্ষী রায়হানকে দেখা যায়, কারা অভ্যন্তরে আগত প্রতিটি ব্যক্তির কাছেই জানতে চাচ্ছেন- পকেটে মোবাইল ফোন আছে কি না। থাকলে পাশের কাউন্টারে জমা দিয়ে তারপর ঢুকতে। একইভাবে বন্দীর সাথে স্বজনদের সাক্ষাৎ করানোর লক্ষ্যে ফ্রি স্লিপ কাটার পর সাক্ষাৎ কক্ষে ডাকা হচ্ছে। ওই সময় যাদের ১৫ দিনের মধ্যে বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ পর্ব হয়ে গেছে তাদেরকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করছেন এবং পরবর্তী সময় জানিয়ে দিচ্ছেন। এরপর যাদের সাক্ষাতের সূচি থাকছে তাদেরকে সাক্ষাৎ কক্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর আগে কারাগারের পূর্ব পাশের রুমে আগতদের সাক্ষাৎ স্লিপ লিখতে দেখা যায়। দেখা যায়, যে কারারক্ষী স্বজনদের নাম লিখছেন তার বুকে ক্যামেরা লাগানো। বুকে ক্যামেরা লাগানো কেন- জানতে চাইলে ওই কারারক্ষী শুধু বলেন, এটা বডি ক্যামেরা, এটায় সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে।

বন্দীর সাথে অপেক্ষমাণ একজন বন্দীর স্বজন কারা কম্পাউন্ডে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি টেকনাফ থানার একটি মাদক মামলার আসামি ছিলাম। দুই মাস আগে এই কারাগার থেকেই জামিনে ছাড়া পেয়েছি। ২৬ দিন কারাগারে আটক থাকার সময় দেখেছি কারাগারে বন্দী সেবায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাথরুমে বসানো টাইলসগুলো চকচক করে। থাকার পরিবেশও ভালো। আগে যে রুমে আড়াই শ’ বন্দী থাকত সেখানে এখন থাকে ১২০ জনের মতো। তবে কারা পুলিশদের কেউ কেউ ভেতরে বন্দীদের কাছে ট্যাবলেট গাঁজা বিক্রি করে বলে জানান তিনি। শুধু কক্সবাজার জেলা কারাগার নয়, দেশের প্রতিটি কারাগারেই এমন দুষ্ট প্রকৃতির কারারক্ষী রয়েছে। তাদের শনাক্তের জন্য আইজি প্রিজন্সের নিজস্ব একটি টিম প্রতিটি কারাগারে গোপনে কাজ করছেন। তারাই অনিয়ম দেখলে সাথে সাথে আইজি প্রিজন সেলে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। তাদের দেয়া প্রতিবেদনে সম্প্রতি এই কারাগারের জেলারকে নোয়াখালী জেলা কারাগারে বদলি করা হয়েছে। তিনি বন্দী বাণিজ্যসহ নানাভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপরই তাকে বদলি করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় কারারক্ষীদের বিরুদ্ধেও সময়ে সময়ে নেয়া হচ্ছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

গতকাল কারা অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আগের কারাগার আর এখনকার কারা প্রশাসন এক নয়। আইজি প্রিজন্স স্যার চাচ্ছেন বন্দীরা তাদের সব অধিকারবিধি মোতাবেক ব্যবহার করুক। এর বাইরে যারাই (বন্দী, কর্মকর্তা ও কারারক্ষী) অবৈধ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কারা প্রশাসন যখন যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার দরকার হবে সেটিই হবে এবং হচ্ছেও।