ভূরাজনৈতিক বিবেচনায়ও সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন

জাতীয় বাজেট ও সশস্ত্র বাহিনী সংস্কারে করণীয় শীর্ষক সেমিনার

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সশস্ত্রবাহিনী সংস্কারে করণীয় শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সশস্ত্রবাহিনী সংস্কারে করণীয় শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা |নয়া দিগন্ত

৩৬ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে আধুনিক ও যুগোপযোগী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে একটা স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। ‘নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস’ এর উদ্যোগে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২০২৬ সশস্ত্র বাহিনী সংস্কারে করণীয় শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ দাবি জানান। নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিসের প্রেসিডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হাসান নাসিরের সভাপতিত্বে গতকাল শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায়ও সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাংলাদেশকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এর আগে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলেও নতজানু সরকার কোনো প্রতিবাদ করেনি। ভারত চায় বাংলাদেশকে নানাভাবে দমিয়ে রাখতে। তাদের সেনাবাহিনী ইসরাইলের সেনাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত। তারা চায় না বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হোক। মূলত তারা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে একসময় ভয় পেত। এ কারণে ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রেখে আমাদের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারেক সিদ্দিকের মতো একজন চাটুকারকে দিয়ে এতদিন পুরো বাহিনীকে পরিচালিত করে আসছিল। পতিত সরকারকে ১৫ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য সক্রিয় ছিল। তারা এখনো অনেকে শক্ত অবস্থায় আছে। এদেরকে আগে তাড়াতে হবে। এদেরকে তাড়িয়ে সংস্কার করতে হবে পুরো সশস্ত্র বাহিনীকে। মানুষ এখনো সেনাবহিনীকে বন্ধু মনে করে। যদি পতিত সরকারের দলকানা কর্মকর্তাদের না তাড়ানো যায় তাহলে সংস্কারও সম্ভব হবে না। হাসিনা সরকারের ল্যাসপেনসার হয়ে তারা সশস্ত্র বাহিনীর কলকাঠি এখনো নাড়াচ্ছে বলেও বক্তারা তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

সেমিনারে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, ৮টি কমিশন গঠন করা হলেও এখনো কেন সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো না? তাহলে কি এই সরকারও চায় না সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার? যদি সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার করা না হয় তা হলে দেশ আবারো স্বৈরাচারের কবলে পড়ে যেতে পারে। তাই এখনই সতর্ক থাকা দরকার।

সেমিনারে বলা হয়, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সর্বোচ্চ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। বাংলাদেশের জনগণ সশস্ত্রবাহিনীকে দেশপ্রেমিক, নির্দলীয় নিরপেক্ষ, সৎ আত্মমর্যাদাশীল এবং জনগণের বাহিনী হিসেবে দেখতে চেয়েছে। বিগত ফেসিস্ট আমলে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তার কক্ষপথ থেকে অনেকখানি বিচ্যুত হয়েছে যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশের জনমানুষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা ও যুগোপযোগী করার জন্য বর্তমান সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা বা সশস্ত্র বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি। অথচ এটা অত্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা উচিত ছিল। দেশের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পেশাদার, শক্তিশালী এবং কার্যকরী সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন। সেমিনারের বক্তারা সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কার কেন জরুরি সে বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে কিভাবে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে যেমন বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ অনেককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতি এবং রাজনীতি বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া দেশপ্রেম, সততা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সশস্ত্র বাহিনীর অপরিকল্পিত সম্প্রসারণে সক্ষমতার পরিবর্তে দায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বক্তারা সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিরত সদস্যদের রাজনীতিবিদ এবং দলীয় বা দুর্নীতিগ্রস্ত কমান্ডের অবিচার থেকে রক্ষার জন্য বর্তমান সামরিক আইন সংস্কারের বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।

দীর্ঘ মেয়াদে বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতির বিষয়ে বক্তারা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় কথা বলতে গিয়ে ফেনী সীমান্তে আত্মঘাতীমূলক ব্রিজ নির্মাণের অনুমতি, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে ভারতকে ফেনী ব্রিজের অদূরে ১০০ একর জমি প্রদান, রেলওয়ে করিডর প্রদান, ভারতের স্বার্থে দিনাজপুরের হিলি থেকে শেরপুর সীমান্তে আত্মঘাতী করিডর নির্মাণের অনুমতি প্রদান ইত্যাদি উল্লেখ করেন। একই সাথে বক্তারা প্রতিরক্ষা সামগ্রিক ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষ্যমতে সশস্ত্র বাহিনীর অসংখ্য ঊর্ধ্বতন অফিসারের সীমাহীন দুর্নীতি, গুম, খুন ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়া, অপর দিকে ধর্ম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় পাঁচ শতাধিক অধিক দেশপ্রেমিক, দক্ষ, সৎ অফিসারকে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, গুম, খুন, জেল জুলুমের শিকার করে চাকরিচ্যুত করা হলেও অদ্যাবধি তার ন্যূনতম সুবিচার পাননি। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বক্তারা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হুমকি বিবেচনায় রাখার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়াও সীমিত বাজেটে জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বন্ধু ভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক জোট গঠনের জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়াও জাতীয় প্রতিরক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের ব্যাপারে সবাই দৃঢ়কণ্ঠে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জনের বিষয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ভিসি ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আবদুর রব, দৈনিক আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য সৈয়দ আবদাল আহমদ, দৈনিক নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি শহিদুল ইসলামসহ সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।

মিনহাজুল আবেদীন শরীফের উপস্থাপনায়, সেমিনারে সশস্ত্র বাহিনী সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন, ব্রিঃ জে (অন) মেজর সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক, পিএসসি (অব.) সাবেক কমান্ডার খন্দকার ইলিয়াস কাঞ্চন, মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ (অব:), লে কর্নেল ফেরদৌস আজিজ (অব:), লেঃ কর্নেল হাসিন (বীর প্রতীক) (বরখাস্ত), কর্নেল মোহাম্মদ শাহনুর রহমান (অব:) জাকারিয়া ছোলাইন (অব:), কর্নেল (অব:) মো: জগলুল আহসান, কর্নেল (অব:) জুহুরুল আহসান, কর্নেল (অব:),কর্নেল (অব:) ফেরদৌস, জাকারিয়া, মেজর রেজাউল হান্নান শাহীন (অব:), মেজর সৈয়দ আবু বকর (অব:), মেজর লম্বর রানা (অব:), লে কমান্ডার মশিউর (অব:) প্রমুখ।