বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলীয় নৌরুট একসময় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরীর সাথে যুক্ত করার সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ পথ ছিল। কিন্তু গত ১৪ বছরে এই রুটে সরকারি যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। বরিশালে বিআইডব্লিউটিসির পূর্ণাঙ্গ অফিস থাকলেও সেবাহীনতার এমন চিত্র উপকূলবাসীর জন্য এখন নিদারুণ বাস্তবতা।
নথিপত্র বলছে, ২০১১ সালের মে মাসে বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়। এরপর পার হয়েছে দীর্ঘ এক যুগ, কিন্তু সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি এখনো এই রুট পুনরায় চালুর মতো সক্ষমতা বা রাজনৈতিক অগ্রাধিকার কোনোটিই দিতে পারেনি। এরই মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি নতুন জাহাজ সংগ্রহ, দু’টি পুরোনো জাহাজ পুনর্বাসন এবং চারটি নতুন জাহাজ নির্মাণাধীন থাকা সত্ত্বেও সমাধান আসেনি।
২০০২ সালে চীনের সহায়তায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এমভি বার আউলিয়া’ সংগ্রহ করা হয়। পরে ২০০৮-০৯ সালে আরো দু’টি পুরনো উপকূলীয় জাহাজ, ‘এমভি আবদুল মতিন’ ও ‘এমভি মনিরুল হক, পুনর্বাসনে ২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজের কারণে এ জাহাজ দু’টি তিন বছরও নির্বিঘেœ চলতে পারেনি। বহু বছর অকেজো থাকার পর এগুলো নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়।
অন্যদিকে ‘এমভি বার আউলিয়া’ জাহাজটির পুনর্বাসন ও ইঞ্জিন পরিবর্তনে বিআইডব্লিউটিসির নিজস্ব তহবিল থেকে আরো ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও জাহাজটি কখনোই নিয়মিত নৌসেবায় ফিরতে পারেনি। বরং সরকারি জাহাজটি গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে প্রমোদভ্রমণের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে বিনা দরপত্রে তুলে দেয়া হয়েছিল, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। ২০২১ সালে ‘চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া-বরিশাল রুটে যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প’ এর আওতায় ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ’ ও ‘এমভি আইভি রহমান’ নামে দু’টি আধুনিক জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। সরকারের ৭৫ ভাগ অর্থে নির্মিত এই জাহাজ দু’টি পরীক্ষামূলক চলাচলে বরিশাল-চট্টগ্রাম রুট অতিক্রম করলেও নিয়মিত সার্ভিস আর চালু হয়নি। বরং এগুলো বর্তমানে চট্টগ্রাম-হাতিয়া ও চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে সীমিত পরিসরে চলছে। সাম্প্রতিক প্রশাসনিক পরিবর্তনের পর এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ‘এমভি টেকনাফ’ ও ‘এমভি মালঞ্চ’।
বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা জানান, বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে নাব্যতার কোনো ঘাটতি নেই। বরং কম শক্তির ইঞ্জিন সংযোজন করায় এসব জাহাজ সাগরমুখী প্রবল জলপ্রবাহ অতিক্রম করতে পারছে না। পরীক্ষামূলক চলাচলে ‘তাজউদ্দিন’ জাহাজটির সময় লেগেছিল ১৯ ঘণ্টা, যা বাণিজ্যিক পরিবহনের জন্য অগ্রহণযোগ্য। প্রকল্প বাস্তবায়নে নিম্নমানের নির্মাণ, দেরিতে সরবরাহ এবং টেকনিক্যাল ত্রুটিসংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে।
১৯৬৪ সালেই চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জ-বরিশাল ও বরিশাল-হাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে পূর্ব পাকিস্তান শিপিং করপোরেশন উপকূলীয় স্টিমার সার্ভিস চালু করেছিল। সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত রুট আজ পুরোপুরি বন্ধ। যে কারণে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা চাঁদপুর হয়ে রেলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার বিকল্প পথটিও হারিয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির ‘৩৫ নৌযান সংগ্রহ প্রকল্পের’ আওতায় ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে আরো চারটি নতুন উপকূলীয় জাহাজ নির্মাণের কথা। ২০২১ সালে চুক্তি হলেও আজ অবধি ৮০ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। তবে সংস্থার চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, চলতি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করে বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে নিরাপদ যাত্রীসেবা চালুর লক্ষ্য রয়েছে।
উপকূলবাসীর প্রশ্ন, যে রুটে ১৪ বছর ধরে সরকারি নৌসেবা বন্ধ, বারবার প্রকল্প, ব্যয়, ইঞ্জিন পরিবর্তন ও পুনর্বাসন সত্ত্বেও যে সঙ্কট কাটেনি, সেই রুট কি সত্যিই আগামী কয়েক মাসে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে? স্থানীয়দের জন্য উত্তরটি এখনো বড় অনিশ্চয়তা।



