সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেই

৩ মাস পর পর ভাতা মাত্র ২,৫৭০ টাকা

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই কর্মক্ষম মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কিন্তু এসব নাগরিকের পুনর্বাসনে সরকারের কোনো উদ্যেগ নেই। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মানুষ সহায়-সম্বল বিক্রি করে নিজের চিকিৎসা করতে বাধ্য হচ্ছে। পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনেক মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ সরকারের উচিত এ সব শিক্ষিত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে।

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্যাক্টরিতে যোগ দিয়েছিলেন তরুণ প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি সকালে মোটরসাইকেলে অফিসে যাওয়ার পথে কুষ্টিয়ার নতুন বাইপাস মোড়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতাল, এএমজেড হাসপাতাল, সাভারের সিআরপি এবং ভারতের ভেলরে চিকিৎসা নেয়ার পরও পঙ্গু জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে। এভাবে সারা দেশে সামিউলের মতো হাজার হাজার উচ্চ শিক্ষিত তরুণ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করলেও তাকে পুনর্বাসনের কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের।

দুর্ঘটনাপরবর্র্তী অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে সামিউল ইসলাম বলেন, শিক্ষিত প্রতিবন্ধী হিসেবে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করি। কিন্তু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই। আমি একটা কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতাম। কোম্পানি চাইলে আমাকে অন্য পোস্টে রাখতে পারতো। আমরা যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, বিশেষ করে যারা হুইল চেয়ারে চলাফেরা করি, তারা এ সমাজেরই একজন নাগরিক। আমরা শিক্ষিত, সচেতন এবং দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো আমরা আমাদের প্রাপ্য নাগরিক সুবিধাগুলো ঠিকভাবে পাচ্ছি না।

সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য যে ভাতা দেয় তিন মাস পরপর মাত্র দুই হাজার ৫৭০ টাকা। সেটা আমাদের জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। একজন প্রতিবন্ধীর নিয়মিত ওষুধ, চিকিৎসা, যাতায়াত ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে এ অর্থ যথেষ্ট নয়। আমরা সমাজসেবা অফিসে গেলে অনেক সময় র‌্যাম্পের অভাবে ভেতরে প্রবেশ করতে পারি না, আবার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলারও সুযোগ পাই না। এ অবস্থায় আমরা নিজদের অসহায় মনে করি।

এ ছাড়া মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, অফিস, এমনকি বাজার- কোথাও আমাদের জন্য চলাফেরার উপযোগী ব্যবস্থা নেই। যদি এসব স্থানে র‌্যাম্প ও হুইল চেয়ার-সুবিধা থাকত, তাহলে আমরাও স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারতাম, সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারতাম।

দুর্ঘটনার শিকার এমন নাগরিকদের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা বাস্তব জীবনের ব্যয় বিবেচনায় বাড়ানোর দাবি জানান সামিউল। এ ছাড়াও সব সরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে র‌্যাম্প, লিফট ও অ্যাক্সেসযোগ্য ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা এবং শিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার দাবি জানান তিনি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভা দিতে কুড়িগ্রাম যাচ্ছিলেন রুমাইনা। ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর উলিপুর থেকে কুড়িগ্রাম সদরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে আনন্দবাজার এলাকায় পৌঁছলে তাদের বহনকারী থ্রি-হুইলারকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি বাস। এতে থ্রি-হুইলার থেকে ছিটকে পড়ে মারাত্মক আহত হওয়ার পাশাপাশি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন রুমাইনা। এ সময় তার ছোট ভাই রোকনও আহত হয়। এ সড়ক দুর্ঘটনায় সবকিছু এলোমেলা হয়ে যায় রুমাইনার। ওই দিনই গুরুতর অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে পাঠান চিকিৎসকরা। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা শেষে পঙ্গু জীবনযাপন করতে হচ্ছে উচ্চ শিক্ষিত এ তরুণীকে।

নিজের দুর্ঘটনাপরবর্তী ভোগান্তির বর্ণনা দিয়ে রুমাইনা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভোগান্তির শিকার হন। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত পাওয়া যায় না। হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সেবা পেতে বিলম্ব ও হাসপাতালে যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় উপযুক্ত চিকিৎসা মেলে না। দুর্ঘটনার পর মানসিক স্ট্রেস, ভয়, হতাশা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব অনেক সময় নিজের ওপর ঘৃণা তৈরি করে। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হওয়ার ফলে তাদেরকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অবমূল্যায়নের শিকার হতে হয়। দুর্ঘটনার পর মামলা, পুলিশ রিপোর্ট, ন্যায়বিচার পেতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে কোনো ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায় না।

এ সব সঙ্কট দূর করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রমা সেন্টার ও জরুরি চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন, পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ, সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য হুইল চেয়ার ব্যবহারের উপযোগিতা নিশ্চিত করা, তাদের ব্যবহারের উপযোগী ওয়াশরুম, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এ তরুণী।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সড়ক নিরাপদ করতে বিদেশী অর্থায়নে যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে তাতে আহত বা পঙ্গু ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি যেন দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা পান সে ব্যপারে পদক্ষেপ থাকছে। এ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-এলেঙ্গা এবং নাটোর-রাজশাহী দু’টি মহাসড়কের ১৪০ কিলোমিটার অংশের দুই হাজার স্পট মেরামত করা হবে। এ সব অংশে সড়কের বাঁক মেরামত, দিকনির্দেশনা ও দুর্ঘটনা সতর্কীকরণ সাইনবোর্ডগুলো মেরামত করা হবে। প্যাকেজ-৩ এর আওতায় ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ৭৭ কিলোমিটার মহাসড়কের নানা প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হবে। সড়কের পাশে থাকা নানা স্থাপনা অপসারণ করা হবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই কর্মক্ষম মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কিন্তু এসব নাগরিকের পুনর্বাসনে সরকারের কোনো উদ্যেগ নেই। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মানুষ সহায়-সম্বল বিক্রি করে নিজের চিকিৎসা করতে বাধ্য হচ্ছে। পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনেক মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ সরকারের উচিত এ সব শিক্ষিত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্ঘটনা কমাতে এবং আহত ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিদেশী অর্থায়নে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নাগরিকরা এর সুফল পাওয়া শুরু করবেন।