- একই বানান অভিধানে ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন
- ফেব্রুয়ারি টার্গেট নিয়ে সংস্কারকাজ শুরু
বইয়ের পাতা কিংবা পত্রিকা অথবা দাফতরিক কোনো রেকর্ডপত্র সর্বত্রই বাংলা বানানে চলছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সঠিক বাংলা বানান জানার জন্য আমরা যে অভিধানের সাহায্য নিয়ে থাকি সেই অভিধানেও একক কোনো রীতি নেই। একেক অভিধানে একেকভাবে বানান দেয়া হয়েছে। ফলে সঠিক বা শুদ্ধ এমন কোনো বানানরীতির এখনো কোথাও দেখা মিলছে না। তবে দীর্ঘ দিন পর হলেও এবার শুদ্ধ বানানরীতি প্রণয়ন করে বিশৃঙ্খল বানানে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ শুরু করেছে বাংলা একাডেমি। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাংলা বানানে একটি অভিন্ন রীতি তৈরি করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন অংশীজনদের সহায়তায় নতুন ও অভিনব একটি অভিধান রচনার প্রস্তুতিও শুরু করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজারে এখন বাংলা একাডেমিরই একাধিক অভিধান রয়েছে। তবে এই অভিধানগুলোতে একই বানান ভিন্ন ভিন্নভাবে লেখা রয়েছে। ফলে লেখার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরও অনেক সময়ই বিভ্রান্তিতেও পড়তে হচ্ছে অনেককেই। বাজারে এখন বেশি প্রচলিত অভিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি বাংলা বানান অভিধান প্রভৃতি। বাজারে একাধিক অভিধান থাকার পরও দেখা গেছে খোদ বাংলা অভিধানেই বানানের ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের বিভ্রাট। ফলে একটি অভিন্ন বানানরীতি এখন সময়ের ও প্রয়োজনের দাবিও বটে। আর এই বাংলা বানানে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে বাংলা একাডেমি।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলা একাডেমি প্রথম ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ১৯৯২ সালে। এর ‘পরিমার্জিত ও সংশোধিত’ সংস্করণ ১৯৯৪-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। ২০০০ সালে এই নিয়মের কিছু সূত্র সংশোধন করা হয় এবং তা ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর পরিমার্জিত সংস্করণের পরিশিষ্ট হিসেবে মুদ্রিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে পরিমার্জিত সংস্করণের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে একাডেমিতে একাধিক সভায় মিলিত হন। এসব সভায় ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ শীর্ষক পুস্তিকা ছাড়াও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বাংলা বানানের নিয়ম বিস্তারিত আলোচনার পর ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ‘পরিমার্জিত সংস্করণের প্রথম পুনর্মুদ্রণ’ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বাংলা ভাষার বানানরীতির জন্য বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’কেই অনুসরণ করা হচ্ছে।
আবার বাংলা বানানের সমতা বা অভিন্নতা যে সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা-ও নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলা যেন বেড়ে যাচ্ছে। কতকগুলো শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় একেক জন একেক রকম বানান লিখছেন। বানানের এসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার কী কী ভাষাতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক এমনকি সামাজিক কারণ থাকতে পারে সে বিষয়গুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানগুলো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বানানের সমতাবিধান করার বিষয়ে যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে। অভিধানে বিকল্প বানান রাখার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য, জনমত এবং যৌক্তিক কিছু কারণ বিবেচনায় কোন কোন বানানের দুটো রূপই অভিধানে রাখা যেতে পারে সেটিও বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এসব বিষয় দেশের বিশিষ্টজনদের সাথে আলোচনা, পরামর্শ এবং তাদের সরাসরি সহযোগিতাও নেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতি প্রণয়নে প্রধানতম অংশীজন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাভাকো) ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় বিশাল এই কর্মযজ্ঞটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বাংলা একাডেমি থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলা বানানরীতি প্রণয়নে সরাসরি জড়িত এমন একজন নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে জানান, বর্তমানে বাজারে যেসব বাংলা অভিধান ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে আমরা সেগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন বানানের যেসব অসঙ্গতি লক্ষ করছি সেগুলোকে একটি ফরম্যাটে এনে তালিকা করছি। এরপর সঠিক ও শুদ্ধ বানানটি লিখে আলাদা একটি ফরম্যাটে তালিকা আকারে পুনরায় বাংলা একাডেমিতেই আবার জমা দেব। এভাবে বিভিন্ন জন তাদের দৃষ্টিতে বানানের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরবেন। এরপর সবগুলো সুপারিশ একত্রিত করে সবার মতামতের ভিত্তিতেই একটি অভিন্ন বানানরীতি প্রস্তুত করা হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে বাংলা একাডেমির ডিজি (মহাপরিচালক) অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম নয়া দিগন্তকে বলেন, বানানে যে বিশৃঙ্খলা চলছে এর ইতি টানতেই এই বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা টার্গেট নিয়েছি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে। তবে তিনি এটাও উল্লেখ করে বানানরীতি সংশোধন বা পরিমার্জন করার কাজটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। একবারেই হয়তো সব কিছু সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে শুরুটা যেহেতু করতে পেরেছি আশা করছি এটা চলমান থাকলে একটি অভিন্ন বানানরীতি তৈরি করাও অচিরেই সম্ভব হবে।