প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতাকেন্দ্রিক দলীয় তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে পতিত আওয়ামী লীগের। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দিল্লিতে গিয়ে নিরাপদে অবস্থান করছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। এর কয়েক মাস পর দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও কলকাতার নিউ টাউনে গিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এরপর থেকে গত এক বছরে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ডজনখানেক শীর্ষ নেতাসহ কেন্দ্রীয় ও মধ্যমসারির অন্তত দুই হাজার নেতাকর্মী কলকাতার নিউ টাউন ও ইডেন গার্ডেনের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে বসেই ওই সব নেতারা দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার হটানোর মিশনে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে অতীতের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন করছে এবং গ্রেফতার করে, মামলা-হামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এ ছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন আওয়ামী লীগ এদেশে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কোনো দিন দেশে ফিরতে পারবে না। এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা বাদ দিয়ে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করেছে সদ্য ক্ষমতা হারানো দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। নতুন টার্গেট হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতিতে হোক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে হটিয়ে নতুন সরকার গঠন করা। মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতার মতে, শেখ হাসিনা শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূসকে হুমকি মনে করছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার হটানোর জন্য একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন হলেও সমস্যা দেখছে না আওয়ামী লীগ। যদিও সেনাপ্রধান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করবেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। ওই নেতা মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নানা সংশয় রয়েছে। এর আগে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে হয় না। ওই সময় যদি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয় আর সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য ড. ইউনূসকে বাদ দিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে অন্তত ২৫/৩০ জন রাজনীতিক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করলে সঙ্কট নিরসন হতে পারে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে হটিয়ে বিকল্প শক্তির উত্থানের জন্য একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে বিশৃঙ্খলার ভয়াবহ ছক কষছে আওয়ামী লীগ। আগামী নভেম্বর থেকে ধীরে ধীরে নানা ইস্যুতে স্বল্প পরিসরে দেশের অভ্যন্তরে থাকা নেতাকর্মীদের রাজপথে নামানোর চিন্তা রয়েছে দলটির। ধাপে ধাপে গিয়ে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে নেতাকর্মীদের চূড়ান্তভাবে সংগঠিত হয়ে রাজপথে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের। এই সময়ের মধ্যে রাজপথে আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের মতো এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় যাতে অন্য কেউ ক্ষমতা নিতে বাধ্য হয়। ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বাড়ানোর জন্য ওই বার্তা ছড়িয়ে দিতে দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় এবং মধ্যম সারির একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে এ তথ্য জানা গেছে।
ঢাকার মধ্যম সারির এক নেতা আলাপকালে বলেন, আওয়ামী লীগ সরাসরি ক্ষমতায় আসবে এমন ভাবনা দলের শীর্ষ পর্যায়ের কারোর মধ্যে এখন আর নেই। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না সেই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। সেনাবাহিনী ও সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে সংঘাত তুমুল পর্যায়ে লেগে গেছে। এরকম নানা ইস্যু তৈরি করার জন্য প্ল্যান করা হয়েছে। এসব প্ল্যান বাস্তবায়ন করার জন্য কোটি কোটি টাকা লগ্নি করা হচ্ছে।
গত ৫ আগস্টের পর জুডিশিয়াল ক্যু’র মাধ্যমে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য পরিকল্পনা করেছিল আওয়ামী লীগ। ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রাম পুলিশের আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলনের ওপর ভর করে দলটি। দেশের পাড়া-মহল্লায় অনবরত সংঘাত সংঘর্ষ সংঘটিত হওয়ার পেছনে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কলকাঠি নাড়েন বলে রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়াও গত ৫ আগস্টের পর ‘মব জাস্টিসের’ ধোয়া তুলে সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এর পেছনে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নেতাদের নির্দেশনায় দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছাত্রলীগের কট্টরপন্থী গ্রুপটি কাজ করে। যদিও এ পর্যন্ত তাদের সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, হিন্দুদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও বাড়িঘর ভাঙচুর, আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটকে কার্যকর, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা আত্মগোপনে থেকে কাজ করছেন। যুবলীগের ওই নেতা আরো বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন নিয়ে এখনই ভাবছে না। দলের শীর্ষ নেতাদের অগ্রাধিকার হলো অন্তর্বর্তী সরকার হটানো। আর সেই টার্গেট বাস্তবায়নের জন্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিকে বেছে নেয়া হয়েছে। আর্থিক খাতে ধ্বস নামানোর জন্য সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের শিল্প কারখানায় নতুন করে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য আওয়ামী সমর্থিত অন্তত ২৫০ কারখানার মালিক গোপন বৈঠক করে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করেছে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করার জন্য মাস্টার প্ল্যান নিয়েও কাজ চলছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর তারা ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে তাদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তিনি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যে লুটপাট, দুর্নীতি, চুরি চামারি করেছে তাদের সহযোগীরা এখনো মনে করে আওয়ামী লীগ সবকিছু পারে। আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসবে। এজন্য আওয়ামী লীগ তাদের ছলচাতুরির মাধ্যমে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাস্তায় নামাতে পারে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।