নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- হামাসের ফেরত দেয়া ৩ বন্দীর লাশ শনাক্ত করল ইসরাইল
 - ‘নতুন গাজা’ নির্মাণের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের
 - ইসরাইল ১৯৪ বার লঙ্ঘন করেছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি
 
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মধ্যেই গাজায় গতকাল আবারো ভয়াবহ ইসরাইলি বিমান হামলা চালানো হয়েছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে ইসরাইলের বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। পশ্চিমতীরে হামলায় এক কিশোরসহ দুই ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পর থেকে অবরুদ্ধ ছিটমহলে ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের জাতীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, সোমবার অধিকৃত পশ্চিমতীরে অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ছয় ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এর মধ্যে নাবলুস শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই পুরুষ ও দুই নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রামাল্লাহর উত্তর-পশ্চিম এলাকা থেকে ও বেইত রিমা থেকেও গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে।
গত বুধবার ইসরাইলের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখবে, তবে যেকোনো চুক্তি লঙ্ঘনের কঠোর জবাব অব্যাহত রাখবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ড জানিয়েছে, রোববার গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের প্রায় অর্ধেকই গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা। এই হামলার ফলে যুদ্ধবিরতির পর থেকে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৬ জনে, যা নিশ্চিত করেছে আলজাজিরা ও দ্য নিউ আরব।
ইসরাইলি বাহিনী গতকাল সোমবার খান ইউনুস ও গাজা শহরের পূর্বাঞ্চলে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। আলজাজিরার লাইভ আপডেটে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সেনারা গাজা শহরে আরো একজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। একইসাথে রেড ক্রসের মাধ্যমে হামাস তিনটি অজ্ঞাত লাশ ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করেছে, যা যুদ্ধবিরতির আওতায় ফেরত দেয়ার তালিকায় ছিল না। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার ৮৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং এক লাখ ৭০ হাজার ৬৬৪ জন আহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গাজার স্থানীয় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। খান ইউনুস পৌরসভা জানিয়েছে, শহরের ধ্বংসস্তূপ সরাতে ২০ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ অপসারণের জন্য ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। আলজাজিরার গাজা প্রতিনিধি হানি মাহমুদ বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি কাগজে থাকলেও বাস্তবে গাজাবাসীর জন্য তা কোনো নিরাপত্তা আনছে না। প্রতিদিনের বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ, ড্রোনের গর্জন- সবই যুদ্ধের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দেয়।’
গাজার বাসিন্দা মাজেন শাহিন বলেন, ‘আমরা আমাদের জীবন পুনর্গঠনের সুযোগ চাই। কিন্তু যুদ্ধবিরতি বারবার ভেঙে যাচ্ছে। শান্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ গাজা শহরের বাসিন্দা সুহা আওয়াদ বলেন, ‘আমরা চাই যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান। শুধু এক-দুই সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি নয়, বরং স্থায়ী শান্তি।’ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির বাস্তব প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক গ্যারান্টির অভাবই গাজায় সহিংসতা বন্ধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হামাসের ফেরত দেয়া ৩ বন্দীর লাশ শনাক্ত করল ইসরাইল
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ফেরত দেয়া তিন বন্দীর লাশ শনাক্ত করেছে ইসরাইল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় গতকাল সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র : বিবিসি।
হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডস জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজার একটি সুড়ঙ্গপথের ধারে তারা এই তিনটি লাশ খুঁজে পায় এবং রোববার রাতে সেগুলো রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করে। ইসরাইলি বাহিনী গাজায় লাশগুলো গ্রহণ করে সেগুলো শনাক্তকরণের জন্য তেল আবিবের ন্যাশনাল সেন্টার অব ফরেনসিক মেডিসিনে পাঠায়। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, ফরেনসিক পরীক্ষা শেষে জানা গেছে লাশগুলো ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কর্নেল আসাফ হামামী (৪০), ক্যাপ্টেন ওমের নিউট্রা (২১) ও স্টাফ সার্জেন্ট ওজ ড্যানিয়েলের (১৯)। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ জানিয়েছে, তিন সন্তানের বাবা কর্নেল হামামী ছিলেন আইডিএফ গাজা ডিভিশনের সাউদার্ন ব্রিগেডের কমান্ডার। ৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাসের আক্রমণের পর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম পৌঁছানো সৈন্যদের একজন ছিলেন এবং সবার আগে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিবুৎজ নিরিমের কাছে লড়াইয়ে তিনি নিহত হন এবং হামাস তার লাশ গাজায় নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন নিউট্রা ইসরাইলি-মার্কিন দ্বৈত নাগরিক এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। পরে ইসরাইলে অভিবাসন করে আইডিএফের সপ্তম ব্রিগেডে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি গাজা সীমান্তের কাছে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হন।
স্টাফ সার্জেন্ট ড্যানিয়েলও আইডিএফের সপ্তম ব্রিগেডে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গাজা সীমান্তের কাছে হামাস বন্দুকধারীদের সাথে যুদ্ধের সময় তিনি নিহত হন। লাশ হস্তান্তরের ধীরগতির কারণে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে এসেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন- গাজা শাসনব্যবস্থা, ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার, হামাস নিরস্ত্রীকরণ ও দুই বছরের বিধ্বস্ত যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠন এখনো এগোয়নি। যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুযায়ী, হামাস সব পণবন্দীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। ১৩ অক্টোবর সব জীবিত ইসরাইলি পণবন্দীকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ইসরাইল ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী ও গাজা থেকে আটক এক হাজার ৭১৮ জনকে মুক্তি দেয়।
এখন পর্যন্ত ইসরাইল ১৮ ইসরাইলি বন্দী ও দুই বিদেশী (একজন থাই, একজন নেপালী) নিহত বন্দীর লাশের বিনিময়ে ২২৫ জন ফিলিস্তিনির লাশ হস্তান্তর করেছে। ইসরাইলের দাবি, গাজায় এখনো আটজন বন্দীর লাশ রয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন ইসরাইলি, একজন তানজানিয়ান ও একজন থাই নাগরিক।
‘নতুন গাজা’ নির্মাণের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের
ইসরাইল নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখণ্ডে ‘নতুন গাজা’ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গাজা পুনর্গঠনের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্ভাব্য দাতাদের কাছে যে প্রধান প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেছে, তার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে, গাজার পূর্বাংশ যেটি বর্তমানে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; সেখানে প্রায় অর্ধ ডজন আবাসিক অঞ্চল নির্মাণ করতে চায় তারা। গত রোববার আরব কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরাইল।
মার্কিন কর্মকর্তারা এই প্রকল্পটিকে ‘নিউ গাজা’ নামে উল্লেখ করছেন। যা ‘ইয়োলো লাইন’-এর পূর্বদিকে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই ‘ইয়োলো লাইন’ হচ্ছে নতুন সীমারেখা, যেখানে যুদ্ধবিরতির অংশ হিসাবে ইসরাইলি বাহিনী (আইডিএফ) পিছু হটে অবস্থান নিয়েছে। আইডিএফের আংশিক প্রত্যাহারের ফলে গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ পায় ইসরাইল। তবে ট্রাম্পের যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ইসরাইল ধীরে ধীরে গাজার সীমান্তের অপর প্রান্তে সরে যাবে এবং গাজা ছাড়বে। তবে এই প্রত্যাহার দু’টি কঠিন শর্তের ওপর নির্ভর করছে- একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠন, যা যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় নিরাপত্তা বজায় রাখবে এবং হামাসের নিরস্ত্রীকরণ। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখায়নি হামাস। এই দুই শর্তই বাস্তবায়ন করা কঠিন হওয়ায় অপেক্ষা না করে পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের শীর্ষ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন প্রথমে ‘ইয়োলো লাইন’-এর ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত অংশ এবং বিশেষ করে দক্ষিণের শহর রাফাহ থেকে কাজ শুরু করতে চায়। মার্কিন প্রস্তাব অনুযায়ী, দুই বছরের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে (যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) ‘ইয়োলো লাইন’-এর ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত নতুন আবাসিক এলাকাগুলোতে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও তখন আইডিএফ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার না-ও করতে পারে। দুই কূটনীতিক জানিয়েছেন, এই লক্ষ্য অত্যন্ত অবাস্তব। এদিকে এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ধারণা বিবেচনা করা হচ্ছে।
ইসরাইল ১৯৪ বার লঙ্ঘন করেছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি
গাজায় ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলি সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১৯৪ বার লঙ্ঘন করেছে। গত রোববার ফিলিস্তিন সরকারের মিডিয়া অফিস এই তথ্য প্রকাশ করেছে। মিডিয়া অফিসের পরিচালক ইসমাইল আল-ছাওয়াবতেহ জানিয়েছেন, লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করে সামরিক অভিযান চালানো, গুলিবর্ষণ, বিমান হামলা, আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে আক্রমণ এবং চিকিৎসাসামগ্রী ও জরুরি সহায়তা পৌঁছানোতে বাধা। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম চুক্তিটি কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনবে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দখলদার বাহিনী নিয়মিত ফিলিস্তিনি জনগণের নিরাপত্তা লঙ্ঘন করছে।’ তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করে বেসামরিক এলাকায় যানবাহন পাঠাচ্ছে এবং হামলা চালাচ্ছে, ফলে বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে। ছাওয়াবতেহ স্থানীয়দের সতর্ক করে বলেন, ওই এলাকায় যাওয়া বিপজ্জনক, কারণ আগেও এখানে কোনো সতর্কতা ছাড়াই বেসামরিক নাগরিকরা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
মিডিয়া অফিস আরো জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি প্রোটোকলে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা লাশ উদ্ধারের জন্য এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারদের জন্য তাঁবু ও মোবাইল হোম সরবরাহ করার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এটি কার্যকর হয়নি। ফলে প্রায় দুই লাখ ৮৮ হাজার পরিবার এখন রাস্তায় বা খোলা স্থানে বসবাস করছে। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো প্রায় ৯ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি নিখোঁজ বা নিহত অবস্থায় আছে। ফিলিস্তিন সরকারের তথ্যে জানা গেছে, গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। এর প্রাথমিক আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। ছাওয়াবতেহ অভিযোগ করেছেন, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে মানবিক সঙ্কট আরো বাড়াচ্ছে এবং রাফাহ সীমান্তে মিসরের দিকে ছয় হাজারের বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে রেখেছে।
 


