নূরুল মোস্তফা কাজী লাহোর থেকে ফিরে
বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত মান নিশ্চিত করে কিডনি ও লিভারের চিকিৎসা সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সে দেশের স্বাস্থ্য পর্যটনকে জনপ্রিয় করতে চায় পাকিস্তান সরকার। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশী রোগীদের নানা সুবিধা দিতেও প্রস্তুত আন্তর্জাতিক মাননিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান জেসিআই এক্রিডিয়েটেড বিশ্বমানের হাসপাতাল পাকিস্তান কিডনি অ্যান্ড লিভার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিচার্স সেন্টার (পিকেএলআইঅ্যান্ডআরসি)। যে প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ২১০০’র বেশি লিভার ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। বিশেষায়িত এই সরকারি হাসপাতালটিকে পাকিস্তানের চিকিৎসা পর্যটনের ব্র্যান্ড হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে।
পিকেএলআই পাকিস্তানের একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, যা বিশেষভাবে কিডনি ও লিভার সংক্রান্ত রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং ট্রান্সপ্লান্ট সেবা দেয়। এটি মূলত পাকিস্তানে এই ধরনের চিকিৎসা সুবিধাকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে নির্মিত একটি সরকারি পর্যায়ের টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র। ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। এটি ‘পাকিস্তান কিডনি অ্যান্ড লিভার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিচার্স সেন্টার অ্যাক্ট ২০১৯’ এর আওতায় পরিচালিত হয়।
লাহোরের ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি এলাকায় বিশাল এলাকাজুড়ে হাসপাতালটির প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত। এ ছাড়া আর একটি বৃহত্তর শাখা রাওয়ালপিন্ডিতে রয়েছে, যা উত্তরাঞ্চলের জন্য পরিচর্যা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
এই হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট; লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ও বোন ম্যারো (হাড়ের মজ্জা) ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়াও ইন্টারভেনশনাল রেডিওলজি ও উন্নত এনডোস্কোপি; ডায়ালাইসিস ইউনিট; গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও হেপাটোলজি; ইউরোলজি ও নেফ্রোলজি; রোবোটিক সার্জারি ও উন্নত অপারেটিং থিয়েটার; ভ্রাম্যমাণ ডায়াগনস্টিক সেবা এবং ইমেজিং (এমআরআই, সিটি, পেট-সিটি); পেডিয়াট্রিক ট্রান্সপ্লান্ট এবং বিশেষজ্ঞ বিভাগসমূহ সবার জন্য উন্মুক্ত।
মাইলফলক ও পরিসংখ্যান : হাসপাতালটি এক হাজারের বেশি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। ১১ হাজারের বেশি কিডনি এবং ১৪টি বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। চার লাখের বেশি রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। জনসাধারণের জন্য প্রায় ৮০% রোগী সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বা সাবসিডাইজড চিকিৎসা পান।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : পিকেএলআইঅ্যান্ডআরসি হলো দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সরকার পরিচালিত হাসপাতাল, যেটি জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে একটি বড় অর্জন। জেসিআই হচ্ছে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা মান নির্ধারণকারী সংস্থা। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর ও উন্নত হাসপাতাল স্বীকৃতি প্রদানকারীদের মধ্যে এটি অন্যতম। যেসব হাসপাতাল জেসিআই এক্রিডিয়েটেড হয়, সেসব হাসপাতালের বৈশিষ্ট হচ্ছে- ১. চিকিৎসা আন্তর্জাতিক মানের; ২. রোগীর নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়; ৩. সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ ব্যবস্থাপনা, অস্ত্রোপচার- সব কিছু ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী; ৪. ডাক্তার, নার্স, স্টাফ- সবাইকে নিয়মিত প্রশিক্ষিত হতে হয়; ৫. হাসপাতাল পরিচালনার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও গুণগত মান বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া যে হাসপাতালে জেসিআই সার্টিফিকেশন আছে- সেখানে চিকিৎসা যেমনি বিশ্বমানের হয়, তেমনি দুর্ঘটনা বা ভুল চিকিৎসার সম্ভাবনা কম থাকে। উন্নত অনেক দেশে জেসিআই স্বীকৃতি ছাড়া ট্রান্সপ্লান্ট বা জটিল সার্জারির অনুমোদন দেয়া হয় না।
পিকেএলআইর হসপিটাল ডিরেক্টর ডা: ফয়সাল আমীর জানিয়েছেন, এই অঞ্চলে কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসায় সবচেয়ে সাশ্রয়ী হাসপাতাল এটি। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে ৮-১০ হাজার মার্কিন ডলার এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্টে ২১-২২ হাজার মার্কিন ডলারে চিকিৎসা সম্পন্ন করা সম্ভব। আশপাশের দেশগুলোতে এ ধরনের চিকিংসায় এর চেয়ে তিন গুণ ব্যয় হবে। বাংলাদেশী রোগীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।
বিশ্বসেরা হাসপাতালগুলোর মানদণ্ড নিরূপণকারী জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল এক্রিডিয়েটেড হসপিটালগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি করে হাসপাতালের পরিচালক স্ট্র্যাটেজিক প্লানিং অ্যান্ড মার্কেটিং ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান ডা: উসমান ইকবাল আজলা জানান, এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বমানের। প্রতি দিন গড়ে পাঁচজন রোগীর লিভার ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে। এখানে আসা রোগীরা সন্তুষ্টি নিয়েই ফেরত যাচ্ছেন। জনসাধারণের সাধ্যের মধ্যে বৈষম্যহীন বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাও এই হাসপাতালের লক্ষ্য। বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতালের সাথে প্রযুক্তিগত সহায়তায় আলোচনা চলছে এবং সেখানকার দু’জন চিকিৎসক ইতোমধ্যে পিকেএলআইয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলেও তিনি জানান।
চিকিৎসা পর্যটনে নজর
এ দিকে পাকিস্তান সরকার কিডনি ও লিভারের বিশ্বমানের চিকিৎসাকে বাংলাদেশীদের জন্য সহজলভ্য করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি সেখানকার পর্যটন শিল্পকেও ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পিকেএলআই লাহোরে অবস্থিত, আর লাহোর শহরকে বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে রয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষিত মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন লাহোর ফোর্ট (দুর্গ) যার অভ্যন্তরে রয়েছে সম্রাট শাহজাহানের গড়া স্ত্রী মমতাজের শীষ মহল। এ ছাড়া রয়েছে মতি মসজিদ ও আলমগীরি গেট। একই স্থানে রয়েছে বিশ্বের বৃহৎ মসজিদগুলোর একটি মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন বাদশাহী মসজিদ। সম্রাট আওরঙ্গজেব নান্দনিক স্থাপত্যের সুবিশাল এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। চার কোণায় চারটি সুউচ্চ মিনার ও তিনটি সুবিশাল গম্বুজের এই মসজিদ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। বাদশাহী মসজিদে প্রবেশের ঠিক আগেই বাম দিকে রয়েছে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত মুসলিম দার্শনিক মহাকবি ড. মুহাম্মদ আল্লামা ইকবালের কবর, যা মাজারই ইকবাল নামে পরিচিত। কবরের সামনে লেখা থম্ব অব আল্লামা ইকবাল। রয়েছে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের স্মৃতি স্তম্ভ হিসেবে মিনারে পাকিস্তান। এ ছাড়া ঐতিহাসিক গাদ্দাফী স্টেডিয়ামের অবস্থানও এই শহরে।
লাহোর থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার দূরে শৈল শহর মারির অবস্থান, যা বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান। পাকিস্তান সরকার কম খরচে বিশ্বমানের উন্নত চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি পর্যটন শহর মারিকেও এক সাথে বাংলাদেশীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে চায়। তাদের চিন্তা মারিতে যে ব্যক্তি একবার যাবে, মারির সৌন্দর্য্য তাকে বারে বারেই টানবে।



