ফ্যাসিবাদ রোধে গণশক্তির ঐকমত্য জরুরি

এমন বিজয় বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি, এমন পতনও তারা দেখেনি।

Printed Edition

রেজাউল করিম খোকন

উনসত্তর, একাত্তর, নব্বই ও তারপর চব্বিশ। স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার বিদায় এবং জনতার জয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ভূলুণ্ঠিত। ৫৩ বছরেও একাত্তরের চেতনায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুশাসন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতা স্থায়ী নয়। জোর করে ক্ষমতায় আসা যায়, অনেক দিন থাকাও যায়। কিন্তু একসময় বিদায় অনিবার্য হয়। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। চব্বিশের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটেছিল আরো করুণভাবে। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন। এমন বিজয় বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি, এমন পতনও তারা দেখেনি। দাম্ভিকতা, অহমিকা, আমিত্ব, বিরোধী মতের মানুষকে কোনোভাবেই সম্মান মর্যাদা না দিয়ে অপমান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় প্রবণতা, চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেখ হাসিনাকে ভয়ঙ্কর পতনের দিকে, মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন এটি তিনি উপলব্ধি না করে আরো বেপরোয়া আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন। তার শেষের দিককার কর্মকাণ্ড দেশের সব মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। তখন শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসন অবসান এবং তার বিদায়ের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি তার পদত্যাগ এবং দেশে ছেড়ে পলায়ন। সবশেষে, পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ। একজন জননেত্রী থেকে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছেন আরো অনেক আগেই।

ঊনসত্তরে সেই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চিত্র, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। সেনাশাসক এরশাদ যেদিন বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনানিবাসে ফিরে গেলেন, সেদিন ঢাকা শহর ছিল মিছিলে মিছিলে একাকার। কিন্তু চব্বিশের মিছিলের সাথে সেই মিছিল, চব্বিশের গণজাগরণের সাথে সেই গণজাগরণের কোনো তুলনা হয় না। সেবার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী জোটসহ বিভিন্ন দল। এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন পেশাজীবীরাও। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। ডিবি অফিসে আটক থাকা ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে সরকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ানোর পরও তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। বাইরে থাকা সমন্বয়করা বলেছেন, এই বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি। শুরুতে তাদের আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নিরীহ দাবিতে। ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলেন। আদালতের এক রায়ে তাদের সেই জয় যখন ছিনিয়ে নেয়া হলো, তখনই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের যখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হলো, তখন ক্ষুব্ধ হলেন। যেই তরুণরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। স্বাধীনতার অনেক পরে তাদের জন্ম। আন্দোলনকারী অনেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। সেই তরুণদের রাজাকারের নাতি কিংবা বাচ্চা বলে উপহাস করা কোনোভাবে মানতে পারেননি। মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হল ছেড়ে দলে দলে সড়কে বেরিয়ে এলেন। তখন পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। অশান্ত হয়ে উঠল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উসকানিমূলক কথায়, যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালাল। সেই থেকে ক্যাম্পাসের আন্দোলন বৃহত্তর রাজপথে ছড়িয়ে যায়। ৯ দফার আন্দোলন এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগে গড়ায়। এরপরের কয়েক দিন ঢাকার রাজপথ নয়, পুরো দেশ হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের মুক্তাঙ্গন। শিক্ষার্থীদের ছাত্র-জনতার সমাবেশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শিশুকে কোলে নিয়ে মা-বাবা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, তরুণ, নারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসেছিলেন মুক্তির স্বাদ পেতে। তখন শহীদ মিনারকেই মনে হয়েছিল গণতন্ত্রের মুক্তমঞ্চ। বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সাথে এসেছিলেন অফিসফেরত সরকারি কর্মকর্তারাও। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। গান গেয়ে, সড়কে ছবি এঁকে, স্লোগান দিয়ে তারা ছাত্রদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সরকারের জবরদস্তির বিরুদ্ধে। দলে দলে লোক শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন।সেখানেও শিক্ষার্থী-তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, মুদিদোকানি, হকার, কে নেই সেই মিছিলে? একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলন। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন মোকাবেলায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা পিস্তল, বন্দুক নিয়ে যে তাণ্ডব চালায়, তাতে একদিনেই শতাধিক মানুষ মারা যান। এর আগেও আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের গুলিতে দুই শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়। শিক্ষার্থীদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন্দ্র করে সারা দেশে সর্বাত্মক গণজাগরণ ঘটে। সরকারের কারফিউ উপেক্ষা করে সকাল থেকে ঢাকায় জনস্রোত আসতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে দলে দলে হাজার হাজার লোক ঢাকায় প্রবেশ করেন। বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসতে থাকে, মহাখালীতে এত মানুষ জড়ো হয়েছেন। গাবতলী থেকে মিছিল করে মানুষ আসছেন। এ পর্যায়ে ঢাকার সব কটি প্রবেশপথ হয়ে ওঠে মানুষের কাফেলা। কাওরানবাজারে দেখা যায় দলে দলে লোক শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেও শিক্ষার্থী-তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, মুদিদোকানি, হকার, কে নেই সেই মিছিলে? উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিল জনস্রোত। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন ত্যাগ করেছেন। মুহূর্তে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে ছুটলেন সবাই। গণভবন অভিমুখে। কেবল এই সড়ক থেকে নয়, ঢাকা শহরের সব দিক থেকে গণভবনের দিকে মানুষ যাচ্ছে। যাচ্ছেই। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু নয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে দেখা গেছে এমন কিছু দৃশ্য যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।

বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণী। যেখানে প্রথমে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে পুলিশ, বিজিবি ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির একমাত্র যোগ্যতা ছিল আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা। বিচার বিভাগে নিষ্ঠুর কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যত বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়া। পদোন্নতি ও সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হয়ে উঠেছিল কে কত বেশি ফাঁসির রায় দিতে পারবেন। এই ঘটনা জেলা আদালত, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দেখা গেছে। আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নমূলক শাস্তি চাপিয়ে দেয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিচার ও আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সামগ্রিকভাবে একটি রক্তপিপাসু পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রত্যেকটি হত্যকাণ্ড ও নিপীড়নের পক্ষে শেখ হাসিনার সাফাই ছিল- ভুক্তভোগীরা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি যে সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করেছিলেন সেখানেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির কথা বলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে গেছেন। দিয়েছেন অন্যায় ও অপকর্মের অবাধ লাইসেন্স। এই বিভাজনের কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বহুল আলোচিত স্লোগান ছিল- তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার। ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণরা শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতির কৌশলটি শুরুতেই ধরে ফেলেছিলেন। এ কারণে তারা সব মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের একত্রিত করতে পেরেছিলেন। সেখানে একমাত্র পরিচয় ছিল ছাত্র। ফলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এক সময় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কারণ, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এটি এমন এক আন্দোলন যেখানে বিভক্তি ও বিভাজন নেই। ডান-বাম, ইসলামপন্থী সবাই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ফলে জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনার শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে।

শেখ হাসিনা তার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল ভয় দেখানো। এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত ও তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি। তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, তার পিতা ও তার পরিবার এ দেশের মানুষকে একটি রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। ফলে গণভবনে বসে এই দেশ শাসন করার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে তার পরিবারের। তিনি কার্যত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি জমিদারিতে পরিণত করতে চেয়েছেন, যার একমাত্র শাসক হচ্ছে তার পরিবার। ফলে তার পতনের সাথে সাথে মানুষের আক্রোশের প্রকাশ ঘটে গণভবনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে। তার পতনের পর উল্লাস প্রকাশ করে। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়ে তার বাবা ও পরিবারকে বাংলাদেশের একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করেছিলেন। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এ নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তার বাবাও যে তার মতো একজন ব্যর্থ স্বৈরশাসক ছিলেন। এই ইতিহাস তিনি আড়াল করে একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করে গেছেন। জোর করে পড়ানো বিকৃত ইতিহাসের বাইরে এ দেশের ছাত্ররা প্রকৃত ইতিহাস জেনেছেন। নতুন প্রজন্ম বানানো ইতিহাসের বয়ান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার পতনের সাথে সাথে বিকৃত ইতিহাসের পতন শুরু হয়। তার বাবার মূর্তিগুলো মানুষ অপসারণ করেছে। টানা ১৬ বছরের শাসনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে; পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ নানা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তা ছাপিয়ে উঠেছে মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা; বেনজীর-মতিউরদের লুটপাটের কেচ্ছাকাহিনী। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু আমজনতার আয় বাড়েনি, ব্যয় বেড়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলেনি। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিতে পারেনি সাধারণ মানুষ। একদা এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের কাছে আসতেন, তাদের কথা শুনতেন। জনগণ বলতে পারতেন, জিনিসপত্রের দাম না কমলে, ছেলেমেয়েদের চাকরি না হলে ভোটের বাক্সে জবাব দেবো। শেখ হাসিনার শাসনামলে সে সুযোগ তিরোহিত হয়। নেতারা বলতেন, নৌকা মার্কা পেলেই চলবে, ভোট লাগবে না। ভোটে জিততে ভোটার লাগে না, দরকার ক্যাডার আর আমলা-পুলিশের। তাই ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, লুটপাট, দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে জনমনে যে ক্ষোভ জমাট বেঁধেছিল, তা আছড়ে পড়েছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নই কেবল উন্নয়ন নয়; জনগণের জীবনমানের উন্নয়নই আসল কথা।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুশাসন। আমরা কি চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর সেই বাংলাদেশ ফিরে পাবো, যেখানে সবাই মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পাবে, অর্থনীতিতে সাম্য আসবে? শেখ হাসিনার পতনের পর সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাসে মেতে উঠেছিল। কিন্তু একই সাথে মানুষের দৃষ্টি পড়েছিল, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। এখন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হতে পারে। বিভাজনের রাজনীতির অবসান ঘটে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ফ্যাসিবাদকে হটানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন এই স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে এ দেশের মানুষের প্রধান কর্তব্য। যেকোনো ধরনের চরমপন্থা স্বাধীনতার অর্জনকে ভুলপথে নিতে পারে। এছাড়া টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমে গতিশীলতা আবশ্যক। যাতে একটি সুষ্ঠুু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখা যায়। একই সাথে গত দেড় দশকে যারা নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিস্ট শাসক ফিরে আসতে না পারে। অন্তর্র্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। অন্তর্র্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা চালুর বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে, অনিয়মে ভরা বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এটি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার আনার অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক ঝুটঝামেলাও আছে। সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। বিভক্তির জায়গাগুলোয়ও নজর দিতে হবে।

রাষ্ট্র সংস্কারের বিরল যে সুযোগ এসেছে, তা-ও হাতছাড়া হয়ে যেন না যায়। দেশের মানুষ আওয়ামী আমলের গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে কতটা মুক্তি পেলো এবং অতঃপর তারা বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক সুযোগ পাওয়ার সুযোগ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছে কি-না, সে মূল্যায়নের সময় কিন্তু এসে গেছে। প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে যা চলছিল, তা স্থিতিশীলতা নয়, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতিতে গড়া অপশাসনের শৃঙ্খল। ওই ব্যবস্থার প্রতি ন্যূনতম গণ-আস্থা থাকলে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে তা খান খান হয়ে যেত না। তারপরও এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনার ‘স্মৃতি কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে’। হাসিনা এখন অতীত। তার শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপ্লবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। ইউনূস সরকারের উদ্যোগগুলো, বিশেষ করে সংস্কার কার্যক্রমকে, টেকসই বা কালজয়ী করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতি ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা কিছুটা অনিশ্চয়তা মানুষকে আশাহত করে। প্রফেসর ইউনূসের সরকার, তার উপদেষ্টাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যে শুধু অন্তর্র্বর্তী প্রশাসনের দাফতরিক কাজ করছেন তা নয়; তারা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করছেন, এমনটিই কাক্সিক্ষত। শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিয়েছে। তাতে বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিষবৃক্ষ ও তার ডালপালা গজানোর ভবিষ্যৎ সুযোগ থাকাটা মোটেও কাম্য নয়। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না। জুলাই অভ্যুত্থানবার্ষিকীতে শপথ হোক : ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য চাই।