রাতের আঁধারে চেলা নদীর পাড় কেটে বালু লুট

সোহেল মিয়া, দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ)
Printed Edition
চেলা নদীর পাড় কেটে লুট হচ্ছে বালু : নয়া দিগন্ত
চেলা নদীর পাড় কেটে লুট হচ্ছে বালু : নয়া দিগন্ত

এক সময় মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সোনালী চেলা নদী এখন যেন এক আতঙ্কের নাম। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের এই নদী ছিল কাশবনে ঘেরা অপরূপ দৃশ্যের প্রতীক। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বালু-লুটে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে নদীতীরের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও রাস্তা-ঘাট।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা প্রশাসনের অনুমোদিত ইজারা ব্যবস্থার আড়ালে প্রভাবশালী আওয়ামী রাজনীতির সাথে সংযুক্ত একটি সিন্ডিকেট প্রতিনিয়ত নিয়মনীতি ভেঙে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন করছে। ইজারার নিয়মে নদীর পাড় থেকে দূরত্ব রেখে এবং বিকেল ৪টার মধ্যে বালু উত্তোলনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে চলছে এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। রাতের আঁধারে ট্রাক ও ট্রলারে বালু তোলার ভিডিও-প্রমাণ স্থানীয়সহ সংবাদকর্মীদের হাতে রয়েছে।

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সারপিনপাড়া, পূর্বচাইরগাঁও, সোনাপুর, নাছিমপুর, রহিমের পাড়া ও পূর্বসোনাপুর- এই ছয় গ্রামের শতাধিক বসতঘর, শত একর ফসলি জমি ও সরকারি খাসজমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও নদীর মাঝখানে বালুর স্তূপ জমে নতুন চর উঠেছে। অনেক বাড়ির অর্ধেক অংশ এখন নদীর কিনারায় ঝুলে আছে। নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হয়ে ভাঙনের গতি আরো বেড়ে গেছে।

স্থানীয় ভুক্তভোগিরা জানান, বিগত পতিত সরকারের রাজনীতির সাথে যুক্ত একটি গ্রুপ নদীতে বালু তোলার নামে বিজিবি ও সংশ্লিষ্ট কিছু পক্ষকে ম্যানেজ করে নির্বিঘেœ কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। তাদের আশ্রয়ে গত কয়েক বছরে ১০-১৫ জন কোটিপতি হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কোটিপতিদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা ও হয়রানির অভিযোগও রয়েছে।

নাসিমপুরের বাসিন্দা ও ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির নেতা হোসাইন আহমদ বলেন, সিন্ডিকেটের হাতে চেলা নদী এখন ধ্বংসের মুখে। প্রশাসনের একটি অংশ এতে জড়িত না থাকলে এভাবে নদী লুট সম্ভব হতো না।

দোয়ারাবাজার উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সামছুল হক নমু বলেন, আগে শত শত মানুষ সনাতন পদ্ধতিতে হাতের বেলচায় বালু তুলতেন। এতে নদীর গতিপথ কিংবা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করেও বহু বছর তা করা যেত। কিন্তু এখন ড্রেজার মেশিন ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নদীর পাড় কেটে অবৈধভাবে নিমিষেই কোটি টাকার বালু লুট করে নিচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র।

সামছুল হক জানান, কিছুদিন আগে সিন্ডিকেট ড্রেজার ব্যবহারের চেষ্টা করলে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করে ও একটি ড্রেজার আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তার দাবি, ইজারাদারের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই; সমস্যা হলো নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলন। ইজারার শর্ত মানেন না। প্রশাসন থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে তত্ত্বাবধানও করে না। ইজারাদাররা নিয়ম না মানলে এলাকাবাসীর চরম ক্ষতি, কিন্তু সেটি দেখার কেউ থাকে না।

দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরুপ রতন সিংহ বলেন, সীমান্ত অতিক্রমকারী কয়েকটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে। বিজিবিকে নিয়মিত টহলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। চেলা নদীর আগ্রাসী ভাঙন, রাতের বালু লুট এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে দোয়ারাবাজারের ছয়টি গ্রাম আজ বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে মানচিত্র থেকে আরো কয়েকটি গ্রাম মুছে যেতে পারে।