পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে একাধিক মিডওয়াটার ট্রলার প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে মাত্র এক মাসেই ১৩টি ট্রলার, লং লাইনার ও সাপোর্ট ভেসেলের অনুমোদন দেয়া হয়। ওই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নিয়ম লঙ্ঘন, স্পেসিফিকেশনবিহীন কাগজপত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তথ্য গোপন করে ট্রলার আনার অভিযোগও উঠেছে।
গ্রস টনেজের তথ্য ছাড়াই ছয়টি মিডওয়াটার ট্রলারের অনুমোদন : ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য-৪ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বাক্ষরিত এক আদেশে সি রিসোর্সেস লিমিটেডের ছয়টি মিডওয়াটার ট্রলার আধুনিক ট্রলারে প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদনে গ্রস টনেজের তথ্য না থাকলেও ১০ শতাংশ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা কমবেশির অনুমতি দেয়া হয়। অথচ নেভাল আর্কিটেক্টদের মতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রুল অনুযায়ী এত বড় সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। এ দিকে সামুদ্রিক মৎস্য আইনের ১৩-এর ১ অনুচ্ছেদে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করার কথা থাকলেও সে আইনেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিস্থাপনযোগ্য ও নতুন ট্রলারের ফিশ হোল্ড ক্যাপাসিটি সর্বোচ্চ ২০০ মেট্রিক টন এবং ভলিউম ৩৪৫ কিউবিক মিটার নির্ধারিত হলেও এই ৬ ট্রলারের ক্ষেত্রে ৪৪০ কিউবিক মিটারের অনুমোদন দেয়া হয়। এটিও স্পষ্টতই সরকারি নির্দেশনার লঙ্ঘন। বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম রশিদুল হাসানের মতে, মিডওয়াটার ট্রলারকে আধুনিক মিডওয়াটার ট্রলার দ্বারা প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কমবেশি করার সুযোগ নেই। জাহাজের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা ও গ্রস টনেজ নির্ধারিত থাকে। সর্বোচ্চ ১-২ শতাংশ বিচ্যুতি হতে পারে। ১০ শতাংশ কমবেশি করার অনুমোদন প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব ও বিপজ্জনক।
স্পেসিফিকেশন ছাড়াও নজিরবিহীন অনুমোদন :
২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর মেসার্স জালাল করপোরেশনের এক ট্রলারের অনুমোদনপত্রেও অনিয়ম দেখা যায়। উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখারের স্বাক্ষরে ওই অনুমোদনপত্রে কোনো স্পেসিফিকেশন উল্লেখ ছিল না বলে সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে নেভাল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নজিরবিহীন ঘটনা। একটি ট্রলার কেমন মানদণ্ডে ও সাইজে তৈরি হবে সেটা অবশ্যই অনুমোদনপত্রে উল্লেখ করতে হবে। এখানেও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ সালের ১৩-এর ১ সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর আরো পাঁচটি লং লাইনার ট্রলারের অনুমোদনে টুনা ও পেলাজিক মৎস্য আহরণের অনুমতি দেয়া হয়, যা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টুনার জন্য লং লাইনার এবং পেলাজিকের জন্য মিডওয়াটার ট্রলার প্রয়োজন। দু’টির জন্য এক ট্রলারে অনুমোদন প্রতারণার শামিল। এসব অনিয়মের বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব ও বর্তমান যুগ্মসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার এ প্রতিবেদককে জানান, এগুলো অফিসে ফাইল করা আছে। ফাইল দেখে বলা যাবে।
এ দিকে ২০২৪ সালের ৩ মে থাইল্যান্ড থেকে ‘এমভি ওয়াইকেপি-১’ নামের একটি ট্রলার তাঞ্জানিয়ার পতাকা নিয়ে আসে। এটি দেখতে মাছ ধরার ট্রলারের মতো হলেও চট্টগ্রাম কাস্টমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, এটি আসলে একটি খালি কার্গো জাহাজ। পরে রাতের আঁধারে গোপনে মাল খালাস করা হয় এবং এটি রাখা হয় ওশান ডকইয়ার্ডে। পরবর্তীতে ১১ জুন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে, যারা ৮ জুলাই কার্যক্রম শুরু করে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনেও ‘কার্গো হলেও দেখতে ফিশিং ভেসেলের মতো’ বলার মাধ্যমে এটিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। যদিও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়েরও কোনো তৎপরতা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এ দিকে সম্প্রতি অভিযোগের ভিত্তিতে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন না থাকায় মৎস্য ট্রলার এফভি রাঙ্গাচৌকা, বটম প্রকৃতির চিংড়ি ট্রলার এফভি মাগফেরাত (রেজিস্ট্রেশন নং এফ-৫০১৮) এবং এফভি রহমত (রেজিস্ট্রেশন নং এফ-৬৩৩৮) ট্রলারগুলোর প্রতিস্থাপনের আবেদন অধিকতর যাচাইয়ের জন্য ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। যদিও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা-২০২৩ এর ১৩ অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপন নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকার পরও ফিরতি চিঠি পাঠানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে ২০০৯ সাল থেকে শেখ পরিবারের অন্যতম শেখ রুবেলের নামে জারি করা একটি অনুমোদনপত্র পরে শেখ হেলালের মাধ্যমে বিক্রি হয় চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপি দিদারের কাছে। অনুমোদনপত্র হস্তান্তর সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি ছাড়াই এটি বিক্রি হয় বলে দুদকে করা একটি অভিযোগ থেকে জানা গেছে।