বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আহরণের মূল কাঠামো- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভেতরেই এখন গড়ে উঠেছে এক ‘ডিজিটাল দুর্নীতির সাম্রাজ্য’। সংস্থার অভ্যন্তরীণ একটি গোপন নথিতে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, মামলার ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থাপনা ও সফটওয়্যার পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জালিয়াতি, নথি বিকৃতি, রাজস্ব ফাঁকি ও প্রশাসনিক হস্তপে ঘটছে।
অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে- ‘ডিজিটাল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’, কেস ট্র্যাকিং স্লিপ ম্যানিপুলেশন, স্টে অর্ডার দীর্ঘায়িতকরণ, কেস ফাইল দমন এবং অডিট বাধার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দাবিদাওয়া অকার্যকর করে রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল ব্যবস্থার অন্ধকার দিক : রাজস্ব বোর্ড যে ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল; যার উদ্দেশ্য ছিল মামলা ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব দাবি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা- সেই প্ল্যাটফর্মই এখন দুর্নীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
এক গোপন চিঠিতে উল্লেখ আছে, ‘একাধিক কর অঞ্চল ও কাস্টমস হাউজে ডিজিটাল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ব্যবহারিক পর্যায়ে মেনশন স্লিপ, স্টে অর্ডার মামলা চেপে রাখার নামে মামলা পরিচালনার তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে স্থগিত রাখা হচ্ছে।’
ফলে আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য রাজস্ব মামলা বছরের পর বছর পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে, আর এর ফাঁকে রাজস্ব দাবির টাকা ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাচ্ছে।
স্টে অর্ডার সংস্কৃতি : আইনের ছায়ায় দুর্নীতি : অভ্যন্তরীণ পর্যবেণ রিপোর্ট বলছে- মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতের স্থগিতাদেশ এমনভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে যে, এটি কার্যত ‘রাজস্ব ফাঁকির বৈধ কৌশল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক েেত্র দেখা যায়, আদালতের আদেশ থাকলেও সফটওয়্যার সিস্টেমে সেটি ‘সম্প্রসারিত স্থগিতাদেশ’ হিসেবে রেকর্ড করা হয়; যা পরে ইচ্ছামতো সময় বাড়ানো হয় ঘুষ বা রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে।
একজন সাবেক কর কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- স্টে অর্ডার এলে এখন পণ্য; আপনি কাকে কত দেন, সেটিই নির্ধারণ করে মামলা চলবে নাকি বন্ধ থাকবে।’
সফটওয়্যার সিন্ডিকেট : সরকারি প্রযুক্তি, বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ : তদন্ত নথিতে দেখা যায়, ডিজিটাল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মূল সফটওয়্যার উন্নয়ন ও রণাবেণকারী কনট্রাক্টর কোম্পানি বারবার ‘সিস্টেম আপগ্রেড’, ‘ডেটা সিকিউরিটি’ ও ‘প্যাচ আপডেট’-এর নামে অতিরিক্ত বিল আদায় করেছে। তবে বাস্তবে দেখা গেছে- সিস্টেমে লগ ট্রেইল সঠিকভাবে সংরতি হচ্ছে না, মামলার ডেটা এডিট বা ডিলিট করার মতা কিছু কর্মকর্তার হাতে, আর সেই ফাঁকেই মামলা গায়েব বা রাজস্ব দাবি শূন্য দেখানোর ঘটনা ঘটছে।
একজন অভ্যন্তরীণ আইটি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এই সফটওয়্যারকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট ব্যবহারকারী চাইলে ডেটা ব্যাকডেট করতে পারেন- এটিই এখন দুর্নীতির মূল অস্ত্র।’
অডিট অবরোধ ও তদন্তে বাধা : অভ্যন্তরীণ নিরীা শাখা ও দুর্নীতি নিরোধ সেল কয়েক দফা এই ধরনের অনিয়ম তদন্ত শুরু করলেও, প্রায় সবগুলোই ‘উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের অপোয়’ থেকে থেমে গেছে।
নথিতে বলা হয়, কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লগ ফাইল টেম্পারিং, অডিট ট্রেল মুছে ফেলা এবং ই-ফাইলিং এন্ট্রি ম্যানিপুলেশন –এর মতো অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
একজন সিনিয়র অডিট কর্মকর্তা বলেন- যেই ফাইলে বড় করদাতা বা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আছে, সেই ফাইলেই ‘স্টে অর্ডার’। তারপর আর কেউ স্পর্শ করতে পারে না।
রাজস্ব তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কট : হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এ ধরনের মামলা স্থগিত ও ডেটা কারসাজির কারণে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়নি। কিছু কর অঞ্চল এমনকি প্রকৃত দাবির তথ্য আড়াল করতে ‘ডুপ্লিকেট কেস এন্ট্রি’ তৈরি করেছে; যা সফটওয়্যার সিস্টেমে রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান বিকৃত করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শুধু প্রশাসনিক দুর্নীতি নয়; বরং ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের নীতিগত ব্যর্থতার প্রতিফলন। একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যে ডিজিটাল সিস্টেমে জবাবদিহিতা ও তথ্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা ছিল, সেটিই এখন তথ্য বিকৃতির হাতিয়ার। এটি নীতি ও প্রযুক্তি- দুই েেত্রই ব্যর্থতা।’
নীতিগত বিশ্লেষণ : প্রযুক্তি নয়, শাসন কাঠামোর সঙ্কট : নীতিগতভাবে দেখা যায়, এনবিআরের ডিজিটাল দুর্নীতির শেকড় তিনটি স্তরে—প্রাতিষ্ঠানিক তদারকির অভাব- সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনার ওপর কোনো স্বাধীন অডিটিং সংস্থা নেই। আইন ও নীতির ফাঁকফোকর ‘স্টে অর্ডার’ ব্যবহারে কোনো সময়সীমা বা জবাবদিহি নেই। বেসরকারি কনট্রাক্টর নির্ভরতা – সরকারি সংস্থার মূল ডেটা বেসরকারি হোস্টিংয়ে রাখা, যা নীতিগত নিরাপত্তা ঝুঁকি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ‘ডিজিটাল গভর্ন্যান্স’ এর বিপরীত দিক- যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে দুর্নীতির সেবায়, স্বচ্ছতার নয়।
বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব দিচ্ছেন- স্বাধীন আইটি ফরেনসিক অডিট ইউনিট গঠন করে মামলাভিত্তিক ডেটা যাচাই; স্টে অর্ডার সময়সীমা ও পর্যালোচনা নীতি চালু; সফটওয়্যার পরিচালনায় বেসরকারি কনট্রাক্টর বাদ দিয়ে সরকারি সমতা বৃদ্ধি; এবং অডিট ও দুর্নীতি দমন সেলকে সাংবিধানিক স্বাধীনতা প্রদান করা দরকার।
বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড যদি সত্যিই “ডিজিটাল রাজস্ব প্রশাসন” প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তাকে প্রথমে নিজের ডিজিটাল দুর্নীতি সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন কেবল সফটওয়্যার দুর্বলতার নয়, প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব কি কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তার “ডিজিটাল স্টে অর্ডার”-এর বন্দি হয়ে গেছে?