সাক্ষাৎকার : মমতাজ মাননান

আগে সংস্কার দরকার একপেশে এই নারী সংস্কার কমিশনের

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
মমতাজ মাননান
মমতাজ মাননান

নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মাননান বলেছেন, নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দেশে বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। নারী অধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্মারকলিপি দেবো। ইতিমধ্যে এক বিবৃতিতে আমরা বলেছি নারী সংস্কার কমিশনের কিছু কিছু প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত হলেও বেশ কিছু সুপারিশ ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এমনকি সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক। সরকারকে এ নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করছি।

নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মাননান পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নারীদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি ধারাবাহিক এবং কষ্টসাধ্য। এর কোনো বিকল্প নেই। শুধু সুপারিশমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নারীকে মেধা অর্জনের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায় করতে হবে এবং বহুপথ পাড়ি দিতে হবে।

নয়া দিগন্ত : নারী সংস্কার কমিশনের পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলছেন কেন?

মমতাজ মাননান : নারী সংস্কার কমিশনকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। মানুষ ইতোমধ্যে কমিশনের বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকারের ওপর বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং নারী সংস্কার কমিশনেরই সংস্কার দরকার। কারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে নারী তাদের গ্রুপ অব ইন্টারেষ্ট এখানে নাই। যারা ধর্মীয় এক্সপার্ট আছে তাদের কোনো নির্দেশনা এখানে নেই। একপেশে একটা মানে এনজিওভিত্তিক যারা মালিক বা তাদের যে ধ্যানধারণা তা নিয়ে মূলত নারী সংস্কার কমিশন একটা সম্পূর্ণ একপেশে কতগুলো সংস্কার প্রস্তাবনা দিয়েছে। তারা খ্রিস্টান ও হিন্দুদের সাথে আলাপ করলেও কোনো মুসলিম এক্সপার্ট বা আলেম ওলামাদের সাথে আলাপ করেনি। ওনাদের কনসেপ্ট হচ্ছে ইসলাম ধর্ম নারীর সমতাবিরোধী, এটা তো ভেতরে ঢুকছে ওনাদের। জাতির আশা আকাক্সক্ষার সাথে ওনাদের কনসেপ্টের কোনো মিল নাই। তাই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নতুন করে নারী সংস্কার কমিশনের পুনর্বিন্যাস করতে হবে, এটাই এখন আমাদের অবস্থান।

নয়া দিগন্ত : নারী সংস্কার কমিশনের এসব প্রস্তাব ও সুপারিশ নিয়ে তো ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজন আছে।

মমতাজ মাননান : জি, অবশ্যই। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি আমরা। কারণ উন্নততর কিছু তো ওনারা দিতে পারেন নাই। বিদ্যমান যে পারিবারিক কাঠামো আছে, বিবাহ বা যে উত্তরাধিকার বা তালাক এসব বিষয়ে উন্নততর কিছু সংস্কার প্রস্তাব ওনারা দিতে পারেন নাই। এই সুপারিশ অভিন্ন পারিবারিক কাঠামোতে যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে তো পরিবারগুলো পুরোপুরি তছনছ হয়ে যাবে।

নয়া দিগন্ত : তার মানে আপনি কি পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার শঙ্কা করছেন?

মমতাজ মাননান : পরিবারগুলো হুমকির মুখে পড়বে। আসলে ওয়েস্টার্ন প্রেসক্রিপশনটা কি? ইসলাম থেকে খারিজ করতে হলে মুসলিম নারীদের তোমরা বাইরে নিয়ে এসো এবং নির্বিচারে তোমরা নারীদের শ্রমবাজারে নিয়ে যাও। তার মধ্যে গণিকাবৃত্তিকে যে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যে সুপারিশ করা হয়েছে, যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক একজন মানুষের পক্ষে এটা বৈধ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব? সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথেই এটি সাংঘর্ষিক শুধু নয়, এমনকি সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক।

নয়া দিগন্ত : কোনো ধর্মও তো পতিতাবৃত্তিকে এ্যালাউ করে না? নারীদের প্রতি জঘন্য পাশবিকতা ও নির্যাতন কিভাবে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির সুপারিশ হিসেবে দেয়া যায়।

মমতাজ মাননান : অবশ্যই করবে না। তাই এসব সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি, যেখানে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হবে। কল্যাণধর্মী শাসনব্যবস্থা। গণিকাবৃত্তি তো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথেই সাংঘর্ষিক। এবং ইসলাম শুধু নারীকে সমতা ও নায্যতা দেয়নি বরং দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভিত্তিতে নারীদের ন্যায্য অধিকার দিয়েছে।

নয়া দিগন্ত : নারী সংস্কার কমিশন পুরুষের তুলনায় নারীদের সম্পদ বন্টনে সমান অধিকারের সুপারিশ করেছে।

মমতাজ মাননান : দেখুন ইসলাম যে নারীদের পুরুষের অর্ধেক সম্পদ দিয়েছে তার সাথে পুরুষের কাঁধে নারীদের দায়দায়িত্ব বা ভরণপোষণের সম্পূর্ণ বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে। একদম কুইট করা হয়েছে। এদিক থেকে নারীদের কোনো দায়দায়িত্ব দেয়া হয়নি। অধিকারের সাথে সাথে দায়িত্বের ব্যাপারটি দেখতে হবে। ইসলাম এখানে ভারসাম্য এনে দিয়েছে। বরং দায়িত্বের দিক থেকে দেখলে নারীকে ইসলাম যা দিয়েছে তা লজিক্যাল এবং ন্যায্য।

নয়া দিগন্ত : মেয়েদের কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে যদি তাদের পণ্যই করে তোলা হয় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য থাকে কিভাবে?

মমতাজ মাননান : গণিকাবৃত্তিতে তো নারীর মর্যাদা থাকে না। নির্যাতিত হতে হতে তার স্বাস্থ্যহানির দিকটি কেউ বিবেচনা করে না। শুধু আর্থিক দিক বিবেচনা করলে হবে না, নারীর ক্ষমতায়ন বা এমপাওয়ার করতে গিয়ে তার সম্মানহানি করা যাবে না। নারীর ক্ষমতায়ন কি শুধু অর্থ কামাই করা? মেয়েদেরকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার দিক থেকে এসব সুপারিশ এসেছে। এখানে নারীর ডিগনিটি থাকে কোথায়, এটা নারীর জন্যে চরম অবমাননাকর।

নয়া দিগন্ত : এমনিতে নারীদের প্রেমের নামে ফুসলিয়ে দেশের বাইরে পাচার করে দেয়া হচ্ছে। এখন গণিকাবৃত্তি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তো নারী পাচার বৈধতা পেয়ে যাবে।

মমতাজ মাননান : একটা মানুষের দেহ কখনো কি পণ্য হতে পারে? তারপর দেখেন যেসব নারী এ ধরনের ঘৃণ্য চক্রে আটকে বাধ্য হচ্ছে দেহব্যবসা চালাতে তাদের হেলথহ্যাজার্ডের কথা কেউ বলে না। ওটা শুধু নারীকেই বহন করতে হয়। আর পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নারী পাচারকেই সহযোগিতা করা হবে। কোনো নারী কি চায় এ ঘৃণ্য ব্যবসা বেছে নিতে। কৌশলে তাদের অর্থনৈতিক সঙ্কটে ফেলে, নিরাপত্তার অভাব তৈরি করে ফাঁদে ফেলে নারীদের এভাবে অন্ধকার গলিতে আটকে রাখা হয়েছে। এখন আবার পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে। কোনো নারীই দেহব্যবসায় নিয়োজিত হতে চায় না, সবাই চায় তার মেয়ে ডাক্তার হোক, প্রকৌশলী হোক, শিক্ষক হোক বা সম্মানজনক অন্য কোনো পেশা বেছে নিক। এ ধরনের প্রস্তাব তারা কিভাবে আনতে পারল, এটা তো বুঝতে হবে ওনারা কি চাচ্ছেন? এগুলো আসলে বিকৃত মানুষের রুচি। এ ধরনের উদ্ভট সুপারিশ ওনারা কিভাবে আনতে পারলেন, তারা বিবেচনায় নেননি অধিকাংশ নারী আসলে কি চান। বিকৃত মানসিকতাই থেকে গণিকাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির সুপারিশ তারা করেছেন।

নয়া দিগন্ত : পশ্চিমা একটা ধ্যান ধারণার পিছনে দেখা যায়, তারা চায় অধিকহারে পণ্য বিক্রি করতে, এটা করতে যেয়ে তারা মানুষকেও পণ্যের মতো জ্ঞান করে।

মমতাজ মাননান : পশ্চিমা সমাজে আসলে মেয়েদের বিভিন্ন প্রকারে ভোগ্যপণ্য করে তোলা হয়। কিন্তু তারাও এখন পণ্য হিসেবে নারীদের উপস্থাপিত করতে গিয়ে দেখছে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন দিবস উদযাপন করে পরিবার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে বা যতটুকু আছে তা অবশিষ্ট হিসেবে টেকসই করে রাখতে চাচ্ছে। ভুক্তভোগী হিসেবে তারা বুঝতে পেরেছে নারীকে পণ্য করে তোলার মধ্যে সমুহ বিপদগুলো। ফাদারস ডে, মাদারস ডে এ ধরনের দিবসের মাধ্যমে তারা পরিবার প্রথাকেই ফিরে পেতে চাইছে।

নয়া দিগন্ত : তাহলে আমাদের দেশে পশ্চিমাদের ভিন্ন প্রেসক্রিপশন কেনো দেয়া হয়?

মমতাজ মাননান : পশ্চিমা দেশগুলো যখন আমাদের মতো দেশগুলোতে আসে তখন তাদের মধ্যে যেহেতু ইসলামফোবিয়া কাজ করে, তাই তারা ইসলামের পরিবার প্রথা যেটি মূল ভিত্তি তা তারা ভাঙতে চায়। এখানে পরিবারগুলো মূল্যবোধ নিয়ে বিকশিত হয় বলে এই পরিবার প্রথার বিরুদ্ধে যায় তারা।

নয়া দিগন্ত : তো পরিবার প্রথা উচ্ছেদ করলে নারী ভবিষ্যতের নেতৃত্ব হিসেবে তার সন্তানকে কিভাবে গড়ে তুলবে, তা আর থাকছে না, সেটা নারীর পরিবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হোক বা পরিবারের বাইরে সামাজিকভাবে হোক।

মমতাজ মাননান : ভবিষ্যতে পরিবার থেকে নারী যাতে আর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম না হয় এজন্যে তারা সুকৌশলে এ ধরনের প্রেসক্রিপশন দেয়। বলা হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়নের কথা কিন্তু পরগাছা হিসেবে তারা নারী বেড়ে উঠুক তা চায়। নারী তার সন্তানদের ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়, আল্লাহর খলিফা হিসেবে কিভাবে তার সন্তান গড়ে উঠবে সেদিকে সে নজর রাখে। তাই পশ্চিমাদের মূল প্রেসক্রিপশন হচ্ছে ইসলামের পরিবার প্রথার ওপর আঘাত হানা। এটাকে ভেঙে দিতে চাচ্ছে তারা। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নারী যাতে তার পরিবার বা সমাজে তৈরি করতে না পারে। পশ্চিমা ধ্যানধারণায় বিকৃত মানসিকতায় যেন গড়ে ওঠে নারী এবং তার পরিবার। এটাই তারা চায়। তারা এই প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন এক শ্রেণীর নারী তাদের খপ্পরে পড়েছে এবং এই নারী সংস্কার কমিশন তো বলার মতো না। তাদের এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দেয়া কোনোমতেই উচিত হয়নি। আমাদের মূল দাবি হলো এ কমিশনকে পুনর্বিন্যাস করে আবার নতুন কমিশন করে আমাদের যে অবজারভেশনগুলো তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

নয়া দিগন্ত : এর তো কোনো বিকল্প নেই?

মমতাজ মাননান : না কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিকভাবে এটি নিয়ে বিরাট আনরেস্ট তৈরি হতে পারে। কেউ কি মেনে নেবে? আসলে এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাবে আমার মনে হয় আরো গভীর ষড়যন্ত্র আছে। দেখেন আর্থিকভাবে আমরা এখন অনেক দুর্দশাগ্রস্ত। এখন সংসদে ৬০০ আসনের মধ্যে আপনি ৩০০ আসনই নারীদের দিয়ে দিতে সুপারিশ করছেন। এত বিপুল সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি কখনো অর্জন করে নাই। নারীদের এ ধরনের সক্ষমতার বিষয়টি এ মুহূর্তে একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত। ন্যূনতম যার বাংলাদেশের ফিন্যান্সিয়াল ও নারীদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা রয়েছে, নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নারীদের উৎকর্ষতা নিয়ে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাছে এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তাবতাবিবর্জিত। এটা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। নারী সংস্কার সুপারিশে একদিকে পুরুষের সাথে সমতা চাওয়া হচ্ছে আবার সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন চাওয়া হচ্ছে এটা তো মিলে না। একদিকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতা, তালাকের ক্ষেত্রে সমতা, ওদিকে আবার সংরক্ষণ এটা সাংঘর্ষিক। নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আগে।

নয়া দিগন্ত : তাহলে ইসলাম নারীদের যে পুরুষের অর্ধেক সম্পদ বণ্টনের বিধি দিয়েছে এটা আগে নিশ্চিত করা তো প্রয়োজন।

মমতাজ মাননান : এখন যে পারিবারিক কাঠামোগুলো আছে, সমাজে যে স্বীকৃতির কথা বলা হয়, সেটাই তো বাবা দেয় না, ভাই দেয় না, স্বামী দেয় না। আমার নিজের পরিবারে আমি ফয়সালা করতে পারিনি। তো বিদ্যমান যে আইন রয়েছে, নারীর অধিকারের ব্যাপারে তা নিশ্চিত করা দরকার। নারী তার পরিবারের কাছ থেকে পাওনা পায় সেটা নিশ্চিত করা উচিত। কঠোরভাবেই তা নিশ্চিত করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া উচিত।