বাজার সঙ্কোচন, অতিনির্ভরতা ও নীতিগত অন্ধত্ব বিপদ ডেকে আনছে

রফতানি-আমদানি

রফতানি-আমদানির সর্বশেষ পরিসংখ্যান এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা সামনে এনেছে। বাংলাদেশ এমন এক বিপজ্জনক ধাপে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রফতানি আয় কমছে, অথচ আমদানিতে চীন-ভারত নির্ভরতাও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নীতিগত স্থবিরতা, রফতানি খাতে বৈচিত্র্যহীনতা এবং উদীয়মান বাজারে নজিরবিহীন পতন। কর্তৃপক্ষের ‘স্থিতিশীলতার ভাষণ’ ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান এখন ভয়াবহভাবে স্পষ্ট।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের রফতানি-আমদানির সর্বশেষ পরিসংখ্যান এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা সামনে এনেছে। বাংলাদেশ এমন এক বিপজ্জনক ধাপে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রফতানি আয় কমছে, অথচ আমদানিতে চীন-ভারত নির্ভরতাও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নীতিগত স্থবিরতা, রফতানি খাতে বৈচিত্র্যহীনতা এবং উদীয়মান বাজারে নজিরবিহীন পতন। কর্তৃপক্ষের ‘স্থিতিশীলতার ভাষণ’ ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান এখন ভয়াবহভাবে স্পষ্ট।

রফতানিতে পতন : গভীর হচ্ছে সঙ্কট

চলতি সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ১১.৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিল-জুনে কমে হয় ১০.৬২ বিলিয়ন। অর্থাৎ ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় কমে যায় মাত্র তিন মাসে। এখানেই থেমে নেই সঙ্কট- দেশভিত্তিক চিত্র আরো উদ্বেগজনক।

অস্বস্তিকর প্রবণতা : শীর্ষ বাজারেই পতন

অস্বস্তিকর প্রবণতা ২: ইউরোপে বিপর্যয়: স্পেন ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশেই কমেছে পোশাকের রফতানি। প্রধান ক্রেতা- জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক- প্রত্যেকটি দেশেই রফতানি পতন হয়েছে। স্পেন একমাত্র ব্যতিক্রম (১৩% বৃদ্ধি)। প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশ কি দক্ষিণ ইউরোপে বাজার ধরে রাখতে সক্ষম কিন্তু উত্তর ইউরোপে ব্যর্থ? শিল্প মহলের মতে, এর কারণ হতে পারে- উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে ‘ডাইভার্সিফাই’ হচ্ছে আর থাকতে পারে পরিবেশ-সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাক্টর।

উদীয়মান বাজারের পতন : নীতিনির্ধারকদের অন্ধ স্পট : ভারত, পোল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ডস- সব মিলিয়ে উদীয়মান বাজারে পতন ঘটেছে ১০-২৫%। এগুলোই সেই বাজার, যেখানে গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগ খুঁজছিল। এই পতন ইঙ্গিত দেয়- ১. বাজার অনুসন্ধান দুর্বল, ২. বিপণন কৌশল অনুপস্থিত, ৩. সরকারি ভর্তুকি-কূটনীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা সৃষ্টি হচ্ছে।

আমদানির চিত্র : চীনের ওপর নির্ভরতা ব্যাপক

২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীনের শেয়ার ২৬.৪%, যা গত বছরের তুলনায় আরো বেড়েছে। এই নির্ভরতা এখন স্ট্র্যাটেজিক ঝুঁকিতে রূপ নিতে শুরু করেছে- ডলার সঙ্কটের সময় চীনা আমদানির চাপ বাড়ায় রিজার্ভ সঙ্কট তীব্র হয়। কাঁচামাল নির্ভরতাকে ব্যবহার করে চীন সরবরাহ শৃঙ্খলে (সাপ্লাই চেইন) প্রভাব খাটাতে পারে এবং বাংলাদেশ শিল্পখাত ‘এক উৎস নির্ভরতার ফাঁদে’ পড়ে গেছে।

ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস (১৪.৩%)। চীন-ভারত দুই দেশের মিলিত আমদানি শেয়ার ৪১%, যা বাণিজ্য ঘাটতিকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

শীর্ষ ২০ আমদানি দেশের তথ্য : একটি কঠিন বাস্তবতা

সংযুক্ত আরব আমিরাত-অস্ট্রেলিয়া-জার্মানি-থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম ১-২%

আমদানি ক্ষেত্রে তিনটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন হলো-১. কেন আমদানির উৎস এত সীমিত?, ২. কেন স্থানীয় উৎপাদন-বিকল্প উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে? এবং ৩. কেন একই সাথে রফতানিতে পতন ও আমদানিতে একসূত্রতা বাড়ছে?

অর্থনীতির ভেতরের লুকানো সঙ্কেত : অর্থনীতির ভেতরের লুকানো সঙ্কেত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে-

১. বাণিজ্য ভারসাম্য এখনই সঙ্কট-সতর্কতা দিচ্ছে। রফতানি কমছে, আমদানি অপরিবর্তিত- রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ ২০২২-২৪ সময়কালে যে ডলার সঙ্কটে পড়েছিল- তার দীর্ঘ ছায়া এখনো কাটেনি।

২. পোশাক নির্ভরতা এখন রিস্কি মডেলে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অটোমেশন, ভিয়েতনাম-তুরস্ক-মরক্কো প্রতিযোগিতা তুলে দিচ্ছে একটি কঠিন প্রশ্ন- বাংলাদেশ কি আর পাঁচ বছরও তৈরী পোশাক-চাহিদার ওপর একইভাবে নির্ভর থাকতে পারবে?

৩. নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার বৈচিত্র্যে কোনো বড় উদ্যোগ নেয়নি, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ব্যবস্থাপনায় রফতানি-সংশ্লিষ্ট শিল্পকে যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে না, আর অর্থ মন্ত্রণালয় উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

কী ঘটতে পারে আগামী ৬ মাসে: বিশেষজ্ঞদের মতে- ইউরোপে চাহিদা আরো কমলে রফতানি আরো ৮-১২% সঙ্কুচিত হতে পারে; আমদানিতে চীনা নির্ভরতা শিল্পকে প্রাইস-শকের মুখে ঠেলে দিতে পারে; ডলার স্থিতি না ফিরলে এলসি সঙ্কট ফের মাথাচাড়া দিতে পারে এবং নতুন বাজার না খুললে রফতানির ‘মার্কেট কনসেন্ট্রেশন রিস্ক’ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

লুকানো নীতি-সমস্যা- যা বলা হয় না: ১. বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে কোনো ‘রফতানি কৌশল’ অনুসরণ করছে না। নীতিপত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ থাকলেও প্রয়োগ নেই। ২. রফতানি পণ্যের বুনিয়াদি বৈচিত্র্য নেই। নতুন সম্ভাবনাময় খাত- ইলেকট্রনিক্স, প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অগ্রগতি প্রায় নেই। ৩. আমদানি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল। বিকল্প উৎস খুঁজতে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রচেষ্টা নেই।

সময় এখন কঠিন সিদ্ধান্তের : প্রতিটি সূচকই ইঙ্গিত দিচ্ছে- বাংলাদেশের রফতানি-আমদানির কাঠামোগত দুর্বলতা এখন আর লুকানো নেই। বাজার সঙ্কোচন, সরবরাহ শৃঙ্খলনির্ভরতা এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার একগুঁয়েমি মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন ঝুঁকির মধ্যরেখায় দাঁড়িয়ে। যদি আগামী এক বছরের মধ্যে বাজার বৈচিত্র্য, উৎপাদন সক্ষমতা এবং আমদানি উৎসের কৌশলগত পুনর্গঠন শুরু না হয় তবে বাংলাদেশ আবারো ডলার সঙ্কট, বাণিজ্য ঘাটতি এবং শিল্প কাঠামোগত সঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারে।