এনসিটিবি ও মাউশির বিভক্তির প্রস্তাবে নানা প্রশ্ন, বাড়ছে ক্ষোভ

প্রতিষ্ঠান দু’টির ক্ষমতা খর্বের অন্তরালে সক্রিয় একটি চক্র

সম্প্রতি মাউশিকে দুই ভাগে ভাগ করে ‘মাধ্যমিক অধিদফতর’ এবং ‘কলেজ শিক্ষা অধিদফতর’ নামে দু’টি পৃথক অধিদফতর করার প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে পাঠানো হয়েছে।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

শিক্ষার প্রধানতম দু’টি সেক্টর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) ভাগ করার প্রস্তাবে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নিয়েও ইতোমধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি মাউশিকে দুই ভাগে ভাগ করে ‘মাধ্যমিক অধিদফতর’ এবং ‘কলেজ শিক্ষা অধিদফতর’ নামে দু’টি পৃথক অধিদফতর করার প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে পাঠানো হয়েছে। অন্য দিকে এনসিটিবিকে ভেঙে এবং তাদের ক্ষমতা খর্ব করে প্রাথমিকের পাঠ্যবই মুদ্রণের দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে (ডিপিই) দেয়ার পাঁয়তারাও শুরু হয়েছে। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার মান ক্রমাগত দিনকে দিন তলানিতে চলে যাচ্ছে, সেখানে ডিপিইর প্রাথমিকের শিক্ষা উন্নয়নের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। ফলে বই মুদ্রণের মতো একটি জটিল কাজ কিভাবে তারা সামাল দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এনসিটিবি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হিসেবেই প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পরিমার্জন, শিক্ষাক্রম অনুসরণে পাঠ্যপুস্তক রচনা, সম্পাদনা, মুদ্রণ ও বিপণনের মতো বিশাল ও জটিল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে আসছে। এনসিটিবি প্রাথমিক স্তরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার নিরবচ্ছিন্ন ধারাকে বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করে আসছে। যেহেতু এনসিটিবির কার্যক্রমের এখতিয়ার জাতীয় সংসদের আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ, সেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব স্থানান্তরের লক্ষ্যে এনসিটিবি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা/উপ ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

সূত্র আরো জানায়, ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে উদ্যোগটি স্তিমিত হয়ে পড়লেও সম্প্রতি এ বিষয়ে পুনরায় উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ তৎপরতার পেছনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মূলত পাঠ্যপুস্তক ও শিখন-শেখানো সামগ্রী মুদ্রণ ও বিতরণে বিলম্ব; এনসিটিবিকে সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রদত্ত অর্থ সাশ্রয় এবং পাঠ্যপুস্তকের নিম্নমান এ তিনটি বিষয়কে যুক্তি হিসেবে হাজির করা হয়েছে। এ তৎপরতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে কেবল মুখোমুখি দাঁড় করানোই নয়; শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর স্বার্থকে হুমকির দিকে ঠেলে দেয়া হবে।

এনসিটিবি মনে করে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার সব স্তরে বিশেষত প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা এবং নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এর মধ্য দিয়ে এনসিটিবির এখতিয়ারভুক্ত অধিক্ষেত্র ও কর্মপরিধিই কেবল খর্ব এবং সঙ্কুচিত করা হবে না, বরং প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব বর্তালে সেটি হবে নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। অবশ্য ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টেক্সট বুক আইন পাস হয় এবং সে আইনের বিধি অনুযায়ী ‘স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যার কাজ ছিল সব বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণ করা। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬, ১৯৬১ এবং ১৯৬৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে ঞযব ঘধঃরড়হধষ ঈঁৎৎরপঁষঁস ্ ঞবীঃনড়ড়শ ইড়ধৎফ ঙৎফরহধহপব ১৯৮৩ (ঙৎফরহধহপব হড়. খঠওও ড়ভ ১৯৮৩)-এর মাধ্যমে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র একীভূতকরণের মাধ্যমে বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধা

সুতরাং এনসিটিবি স্বায়ত্তশাসিত ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিতরণ এবং বিপণনের কাজ আইনি এখতিয়ারভুক্ত। সেই সাথে বোর্ডের সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণ বাবদ এনসিটিবি আইনসিদ্ধভাবে যৌক্তিক হারে প্রয়োজনীয় ফি, রয়্যালটি, সার্ভিসচার্জ, ওভারহেড কস্ট সংগ্রহ করে থাকে।

উল্লেখ্য, পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও বিতরণের জন্য এনসিটিবির একটি বিশেষায়িত ‘পাঠ্যপুস্তক উইং’ রয়েছে যা সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) দ্বারা পরিচালিত হয়। এই উইং-এর দুইটি শাখা রয়েছে : ১. উৎপাদন শাখা এবং ২. বিতরণ শাখা। এই দুই শাখায় পাঠ্যপুস্তক ছাপানো (উৎপাদন) এবং বিতরণের কাজে একনিষ্ঠভাবে ১৪৮ জন স্থায়ী কর্মচারী এবং ১১ জন কর্মকর্তা (প্রেষণ) নিয়োজিত রয়েছেন। পুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কাজে এই ১৪৮ জন কর্মচারীর ন্যূনতম ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এনসিটিবির মোট ৪৯৮ জন স্থায়ী কর্মচারী ও ৭৯ জন কর্মকর্তার (প্রেষণ) যৌথ প্রচেষ্টার ফলে বিপুলসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে দেশব্যাপী বিতরণ করা সম্ভব হয়। এমতাবস্থায়, পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও বিতরণের কাজটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দেয়া হলে সেখানেও অনুরূপ বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগের প্রয়োজন হবে, যা একই সাথে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ এই অধিদফতরের দায়িত্বের অধিক্ষেত্র নয়। এ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা থাকাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতায় তাদেরকে ১০ কোটির অধিক পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

ইতোমধ্যে ২০২৬ সালের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা নভেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে সমাপ্ত হবে এবং ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে বিতরণ সম্পন্ন হবে। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের নিম্নমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। উল্লেøখ্য যে, ২০২৫ সালে বিতরণকৃত প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের মান পরীক্ষা করে সন্তোষজনক পাওয়া গেছে। তবে বিগত সরকারের বছরগুলোতে দুর্নীতির কারণে কিছু পাঠ্যপুস্তক নিম্নমানের প্রতীয়মান হয়েছিল, যা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বই ছাপার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি এক ছাতার নিচে থাকলে ভালো। অন্য দফতরে গেলে সমন্বয়হীনতা, টেন্ডার ও মুদ্রণ তদারকিতে জটিলতা বাড়তে পারে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে সময়মতো মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে না পারা। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে এনসিটিবির কার্যপরিধি সঙ্কুচিত হবে আর প্রাথমিক শিক্ষায় নীতি ও বাস্তবায়নে দু’টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভাজন তৈরি হতে পারে। কাজেই বিভাজন ও বিভক্তির এই উদ্যোগ থেকে এখনই সরকারকে সরে আসতে হবে।