ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ভোটের আমেজ তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসন পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবর্তন এসেছে, তার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে এ আসনে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ আসনে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী হয়েছেন হাফ-ডজনেরও বেশি প্রার্থী। স্থানীয় পর্যায়ে চলছে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, পথসভা ও উঠান বৈঠক। গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন করে সাজানো বিএনপির কার্যালয়ে এখন নেতাকর্মীদের ভিড়। তবে প্রার্থীদের বহুল উপস্থিতি দলটির ভেতরে বিভাজন ও মেরুকরণ বাড়িয়ে তুলছে।
বিএনপির ত্যাগী নেতারা অভিযোগ করছেন, যারা আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে মাঠে থেকেছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বরং অনুপ্রবেশকারীরা টাকা-পয়সার জোরে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এতে ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে।
অন্য দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে তাদের একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ঢাকা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও সাবেক ছাত্রনেতা মাওলানা মো: আফজাল হোসাইন এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ চালাচ্ছেন। বিএনপির একাধিক প্রার্থীর বিপরীতে জামায়াতের একক প্রার্থী থাকায় অনেকেই মনে করছেন তিনি প্রতিযোগিতায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। তার মূল বার্তা ‘মদিনা সনদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি রোধ করা এবং সাভার-আশুলিয়াকে পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা।’
এ আসনে ভোটাদের সংখ্যা
ঢাকা-১৯ আসনটি সাভার উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও পৌরসভা নিয়ে গঠিত। ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী মোট ভোটার সংখ্যা ৯ লাখ ১৯ হাজার ৮০৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৩ এবং নারী ভোটার ৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৮৩। ট্রান্সজেন্ডার ভোটার রয়েছেন ১৫ জন। এ আসনের দুইটি ইউনিয়ন অন্য আসনে যুক্ত হওয়ার কথা উঠেছে। এমনটি হলে ভোটার সংখ্যা কিছুটা কমতে পারে।
ভোটারদের বড় অংশই গার্মেন্ট শ্রমিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও এখানে ভোটার রয়েছেন। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোটাররা সচেতনভাবে যোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেবেন।
বিএনপির মনোনয়ন প্রতিযোগিতা
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়ন পেতে হলে তিনটি যোগ্যতা অপরিহার্য। আন্দোলনে অংশ নিয়ে দলের জন্য সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সুনামের অধিকারী এবং স্থানীয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা।
অন্য দিকে দলের হাইকমান্ডের ভাবনা- দলীয় সঙ্কট কাটিয়ে নতুন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখা। তাই বিতর্কিত বা অজনপ্রিয় হেভিওয়েটদের বাদ দিয়ে তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের সামনে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা হলেন- ১. ডা: দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বাবু। তিনি সাবেক দুইবারের সংসদ সদস্য, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহপরিবার পরিকল্পনা সম্পাদক। ২. খন্দকার শাহ মঈনুল হোসেন বিল্টু। তিনি ঢাকা জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ও সাভার পৌর বিএনপি সভাপতি। ৩. মেজর (অব:) মিজানুর রহমান। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ৪. আব্দুর রহমান বাবুল। তিনি সাবেক ছাত্রদল নেতা ও আশুলিয়া থানা বিএনপির সহসভাপতি। ৫. রাশেদুল আহসান রাশেদ। তিনি ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ৬. আলহাজ জামাল উদ্দিন সরকার। তিনি সাভার থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং ৭. মোহাম্মদ আইয়ুব খান। তিনি ঢাকা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক।
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে আলহাজ মোহাম্মদ ফারুক খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি আলী আশরাফ তৈয়ব এবং গণঅধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট শেখ শওকত হোসেন প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নির্বাচনী মাঠের চিত্র
বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচিই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, জনসাধারণের দুঃসময়ে সহায়তা করা, জুলাই বিপ্লবের শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, অনুদান প্রদানসহ নানা কর্মকাণ্ডে তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ফলে নির্বাচনী মাঠ এখন থেকেই বেশ সরগরম হয়ে উঠছে।
প্রার্থীদের প্রত্যাশা ও ভোটারদের অপেক্ষা
জামায়াত প্রার্থী আফজাল হোসাইন স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বন্ধ, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি এবং তার দল গুরুত্ব দেবে। অন্য দিকে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জানান, মনোনয়ন চাইব কিনা সেটা বড় বিষয় নয়, আমি চাই দেশ ও জাতির সেবা করতে। ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- তারা বলছেন, দীর্ঘদিন পর অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ আসছে। তারা চান যোগ্য প্রার্থীই যেন বিজয়ী হন।
ঢাকা-১৯ আসন ঘিরে ভোটাররা বলছেন, বিএনপি যদি একক শক্তি হিসেবে প্রার্থী ঠিক করতে না পারে, তবে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে বাড়তি সুবিধা নিতে পারে। ফলে নির্বাচনী মাঠে সমীকরণ ক্রমেই জটিল হয়ে যাচ্ছে। তবে এ কথা নিশ্চিত, এবারের নির্বাচন অতীতের মতো একপেশে হবে না। বরং সাভার-আশুলিয়ার মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে।