সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক আবদুর রব

মানবিক করিডোরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হবে কি না স্পষ্ট হতে হবে

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একটি ‘বন্ধুত্ব সবার সাথে, বৈরিতা কারো সাথে নয়’ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত হতে পারে।

মাসুমুর রহমান খলিলী
Printed Edition
সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক আবদুর রব
সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক আবদুর রব

দেশের বিশিষ্ট ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও মানারাত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব মনে করেন, রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তা শাসক ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয় থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য সহায়তা পাঠানো যেমন জরুরি তেমনি বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও জরুরি। তাই করিডোরটি শুধু মানবিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে তা স্পষ্ট হতে হবে। এটি করা হলে আমরা বুঝতে পারব করিডোরটির আসল উদ্দেশ্য কী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুর রব বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। তিনি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এমআইইউ) আগেও ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইনে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের করিডোর প্রস্তাব এবং পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে নয়া দিগন্তের সাথে কথা বলেছেন ড. আবদুর রব। গতকাল তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী। নিচে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত-

প্রশ্ন : দেশের একজন শীর্ষ ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি রাখাইনে মানবিক করিডোরের যে প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে সেটাকে কিভাবে দেখেন?

ড. আবদুর রব : বেশ কিছু দিন ধরে রাখাইনের জন্য একটি মানবিক করিডোর দেয়ার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে এ করিডোরের জন্য আগেই অনুরোধ করা হয়েছে। তবে জাতিসঙ্ঘের হিউম্যানিটেরিয়ান করিডোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রস্তাবের প্রতি শর্তসাপেক্ষে নীতিগত সম্মতি প্রকাশ করেছে। এ শর্তগুলো এখনো সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি এবং জাতিসঙ্ঘের সাথে বিস্তারিত আলোচনার বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। করিডোরের সাথে নানা ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেসব আমলে নিয়েছে কিনা আমরা তাও জানি না। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবনায় ঠিক কি রয়েছে এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী কী শর্ত দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে উপসংহারে আসা যাবে না। সে জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

অতীতে অনেক জায়গায় মানবিক করিডোর নিরাপত্তা ঝুঁঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষ এ করিডোরে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডোরে হামলায় সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডোরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। করিডোরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া অস্ত্র পাচার এবং জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এ করিডোর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদিও বাংলাদেশ ও রাখাইনের মধ্যকার করিডোরটি জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে আলোচনায় এসেছে, তার পরও আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় এসব ঝুঁঁকি মাথায় রাখতে হবে। তবে রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তা শাসক ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয় থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য সহায়তা পাঠানো যেমন জরুরি তেমনি বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও জরুরি। তাই করিডোরটি শুধু মানবিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে তা স্পষ্ট করা হলে আমরা বুঝতে পারব করিডোরটির আসল উদ্দেশ্য কী।

প্রশ্ন : রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ মানবিক করিডোরের বিরোধিতা করে বলছে এটি দেয়া হলে অঞ্চলটি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে পরিণত হবে আবার এটাও বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আপনি কি মনে করেন?

ড. আবদুর রব : এ মানবিক করিডোর প্রদানের সাথে আঞ্চলিক রাজনীতি, আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা, আর্থিক ও সামরিক বিষয়াদি জড়িত। রাখাইনকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নানা ধরনের মেরুকরণের সূচনা হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৌশল সাজাতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডোর সুবিধা দেয়াসংক্রান্ত সরকারের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে। প্রথমত, জাতীয় ঐক্য ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া খুব ঝুঁঁকিপূর্ণ। তাই রাজনৈতিক দলগুলো আশা করে সরকার এ রকম জাতীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের এক্সপার্ট টিম করে সরকার সম্ভাব্য ঝুঁঁকি ও চ্যালেঞ্জ বের করে সেসবের মোকাবেলায় কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, মিয়ানমারের বেশিরভাগ রোহিঙ্গা এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। আরাকান আর্মি আর মিয়ানমার জান্তা উভয়েই রোহিঙ্গাদের সাথে নির্মম ব্যবহার করেছে। স্বার্থ বিবেচনায় এ করিডোর আরাকান আর্মিকে শক্তিশালী করবে, যা সীমান্তে সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা বাড়াবে। কারণ, আরাকান আর্মির সাপ্লাই তাতমাদো বা জান্তা সরকার বন্ধ করেছে যাতে তারা দুর্বল হয়। এখন করিডোর দিয়ে যাই পাঠানো হোক, সেটা বর্তমানে রাখাইনের ৯০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মিকেই সাহায্য করবে। ফলে এ করিডোর জান্তা তথা তাতমাদোর একটা পটেনশিয়াল টার্গেটে পরিণত হওয়া খুবই সম্ভব। আর জান্তা যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পালটা আক্রমণ করে বসে তা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ওই করিডোরের বিরোধিতা করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে এবং আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে তাদের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ কেন, তা-ও জানতে চেয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

যেহেতু জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সরাসরি কিছু উল্লেখ নেই তাই করিডোর প্রস্তাবের বিকল্প নেই বলে যা বলা হচ্ছে আমি তা মনে করি না। কেননা ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত বলা হলেও এর বেশ কিছু দিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সাথে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। তাই জাতিসঙ্ঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ আঞ্চলিক সব শক্তিকে সম্পৃক্ত করে মানবিক করিডোর গঠন করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা সবচেয়ে ভালো বিকল্প বলে মনে করি।

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিনের তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা এবং সাম্প্রতিক আরাকান আর্মির বান্দরবানের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠান করা- এসব কি পাহাড়ের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে?

ড. আবদুর রব : নাথান বম ২০২২ সালে তৈরি করেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। গত কয়েক বছরে এ সংগঠনটি হয়ে উঠেছে বান্দরবানের মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রথম দিকে অপহরণ ও চঁাঁদাবাজির মাধ্যমে তারা তহবিল সংগ্রহ করত। পরবর্তী সময়ে টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এরপর রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের মোট ৯টি উপজেলার সমন্বয়ে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করে তারা। সীমান্ত এলাকায় যখন মিয়ানমারে নানা বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর উত্থান ও সংঘর্ষ চলছে, এমন সময় কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কারণ, দেশের সীমান্ত ও সীমান্তের বাইরে যে কয়েকটি স্থানে কুকিরা রয়েছে, তারা একত্র হয়ে চীন সীমান্তঘেঁষা একটা খ্রিষ্টান স্টেট তৈরি করতে চায় বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। এর সাথে যোগ হয়েছে সম্প্রতি মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যদের বান্দরবানের থানচির রেমাক্রি ইউনিয়নের ঝিরিমুখ এলাকায় জলকেলি উৎসব। যেখানে অস্ত্রধারী আরাকান আর্মির সদস্যরা প্রকাশ্যে গান, নাচ ও বক্তৃতার মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। উৎসবস্থল আরাকান আর্মির পতাকা ও প্রতীকে সজ্জিত ছিল, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ দু’টি বিষয় পাহাড়ের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : প্রতিবেশী দেশের এক শ্রেণির মিডিয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেয়ার কথা বলছে, এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি দেখতে পান কি?

ড. আবদুর রব : প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে সমর্থন দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় বসিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। ফ্যাসিস্ট-পরবর্তী সময়ে আমরা আশা করেছিলাম তারা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে কিন্তু তার পরিবর্তে তারা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং সেদেশের সরকার ও মিডিয়া বাংলাদেশ বিরোধী নানা মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাতে থাকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তারা একধরনের প্রপাগান্ডা চালাতে থাকে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে তারা বৃহৎ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেদেশে সামান্যসংখ্যক আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করছে এবং তাদেরকে ফেরত যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের কপটতা ও দুরভিসন্ধি প্রকাশ পায়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানারকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিবিরে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপড়েন ও মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর একটি আবদ্ধ স্থানে কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করার কারণে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাও লক্ষ করা যাচ্ছে।

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তার জন্য জরুরি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

ড. আবদুর রব : পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর পূর্ব দিকে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে ত্রিপুরা, পূর্ব দিকে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশ। এই পুরো অঞ্চলটি সঙ্ঘাতপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পুনঃমূল্যায়ন করে নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব সেনা নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলোর সাথে যোগাযোগ, জনবসতি, জননিরাপত্তা, অবস্থানগত কৌশল, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রভৃতি জড়িত ছিল এবং এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। কাজেই অবিলম্বে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পের স্থান সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনানুযায়ী এসব ক্যাম্পের স্থানে সেনা অবস্থান বা সেনা টহল নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে যোগাযোগ, অবকাঠামো ও পর্যটন উন্নয়নের কারণে যেসব স্থানে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, সেসব স্থানে প্রয়োজনানুযায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন ও সেনা টহল বৃদ্ধি করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু ও বাংলাদেশে সীমান্তে আরাকান আর্মির তৎপরতা বিবেচনা এবং মাদক, অস্ত্র পাচার বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বিন্যাসে পুনর্মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও পাহাড়ের কৌশলগত গুরুত্ব, স্পর্শকাতরতা, ভঙ্গুরতা, ভূরাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বদা বিবেচনায় রাখতে হবে। সেনাবাহিনীসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী, সদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে। এখানে গোয়েন্দা সংস্থারও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। মনিপুর, চিন ও রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহ ও চাঞ্চল্য যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তার না করতে পারে সে জন্য রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগতভাবে পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের লুক ইস্ট নীতি এক দেশ নির্ভরশীলতা কাটাতে সাহায্য করবে বলে অনেকের ধারণা। আলাদা আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার কোনো প্রভাব এতে পড়বে বলে কি মনে করেন?

ড. আবদুর রব : ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ২০০৯ সালে লুক ইস্ট নীতি গ্রহণ করে সরকার। এরপর পেরিয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও এখনো প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক কাক্সিক্ষত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি; বরং নানা কারণে গভীর হওয়ার আগেই এ সম্পর্ক ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি নিয়ে একাধিক চুক্তি রয়েছে। সরাসরি ফ্লাইট চালু, কৃষি, যোগাযোগ, সংস্কৃতি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসহ অনেক কিছু। শুধু পশ্চিমা নির্ভরশীল না হয়ে পূর্বের সাথেও সম্পর্ক গাঢ় করার সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের। ধীরে ধীরে পূর্বের রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে তবে তা এখনো সীমিত। সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি রোহিঙ্গা সঙ্কট। এ সঙ্কট মোকাবেলায় পূর্বের বৃহৎ দেশগুলোকে পাশে পায়নি বাংলাদেশ। ধারাবাহিকভাবে কূটনৈতিক প্রয়াস চালানোর পরও ইস্যুটিতে শুরু থেকেই মিয়ানমারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে পূর্বের বড় দেশগুলো। তাই রাখাইনে আলাদা আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা এতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়। কারণ এ অঞ্চলের বড় রাষ্ট্রগুলো এখনো মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে সমর্থন ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা মিয়ানমারের অখণ্ডতা নষ্ট হোক তা চাইবে না। মিয়ানমারে তাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ ও সামরিক স্বার্থ রয়েছে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর সাথে সম্পর্কে কী ধরনের ভারসাম্য অনুসরণ করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. আবদুর রব : বাংলাদেশের মতো একটি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশকে পরাশক্তিগুলোর (যেমন : যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া প্রভৃতি) সাথে সম্পর্ক গঠনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তববাদী কূটনীতির পথ অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশ বহুমাত্রিক কূটনীতি (Multi-vector diplomacy) অনুসরণ করতে পারে; অর্থাৎ বাংলাদেশ একক কোনো পরাশক্তির প্রতি নির্ভর না করে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। কোনো পরাশক্তির বিরোধিতা বা পক্ষপাত ছাড়াই জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার নীতি অনুসরণ করতে পারে। বিশেষ করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা বা ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে হবে, যাতে কোনো পক্ষকে চরমভাবে বিরক্ত না করে নিজের স্বার্থ বজায় রাখা যায়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একটি ‘বন্ধুত্ব সবার সাথে, বৈরিতা কারো সাথে নয়’ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত হতে পারে।

প্রশ্ন : পাহাড়ের উন্নয়ন, সম্পদ আহরণ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?

ড. আবদুর রব : পাহাড়ি অঞ্চলকে উন্নয়নের মূলধারায় আনতে হলে প্রয়োজন সংবেদনশীলতা, টেকসই ও পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে গঠিত একটি সমন্বিত রোডম্যাপ। কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নয়, বরং মানবসম্পদ, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করেই এই সম্ভাবনার ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারে-

১। টেকসই ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা : পাহাড়ের বাঙালি ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ (যাতে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে)।

২। সম্পদ আহরণে টেকসই ব্যবস্থাপনা : বনসম্পদ ও খনিজসম্পদ আহরণে পরিবেশগত মূল্যায়ন (ঊওঅ) বাধ্যতামূলক করা। পাহাড়ি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ও স্থানীয় শিল্প ও কুটিরশিল্প উন্নয়নে সহায়তা করা।

৩। পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়ন : ইকো-ট্যুরিজমের (ঊপড়-ঃড়ঁৎরংস) মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলকে পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং নিরাপত্তা, পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৪। কৃষি ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা : শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণের জন্য ক্ষুদ্র বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ।

৫। নিরাপত্তা ও সামাজিক সংহতি : পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও সহাবস্থান তৈরির উদ্যোগ (যেমন : সাংস্কৃতিক মেলা, যুব বিনিময় প্রোগ্রাম)।

প্রশ্ন : চট্টগ্রামের নিরাপত্তার জন্য ‘ফেনিনেক’কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির মুখপত্র রিপাবলিক টিভির আগ্রাসী প্রচারণা অনেকের মধ্যে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন এবং ভারতের আদানি গোষ্ঠীকে দেয়া এ অঞ্চলের ইপিজেড বাতিল করা উচিত বলে কি মনে করেন?

ড. আবদুর রব : এটি ভারতীয় মিডিয়ার অতি বাড়াবাড়ি। তাদের চিকেন নেকের বিপরীতে বাংলাদেশের ভূকৌশলগত দুর্বল জায়গা হিসেবে ‘ফেনিনেক’ বলা হলেও আমি তা মনে করি না। ইপিজেড বাতিলকে আমি সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখি না, কারণ তাতে দুই দেশের মধ্যকার বিরাজমান উত্তেজনা আরো বাড়বে; বরং ইপিজেডকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সামরিক ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে বিষয়ে মনযোগ দেয়া উচিত।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন?

ড. আবদুর রব : বাংলাদেশের নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক একটি গভীর রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও জনআস্থার সঙ্কটকে প্রতিফলিত করে। বিষয়টি শুধু একটি ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার সমস্যা নয়, বরং এর সাথে জড়িত গণতন্ত্রের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের প্রশ্ন জড়িত। তাই ফ্যাসিস্ট সরকারের ভূত যাতে আর না ফিরতে পারে সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ককে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি।