চট্টগ্রামে হত্যার শিকার বিএনপি জামায়াতের ৩০ নেতাকর্মী

আওয়ামী নির্মমতা-বীভৎসতার ১৫ বছর, ১৪০০ মামলার বোঝা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটে লক্ষাধিক মানুষের

Printed Edition

নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে। ফলে ফ্যাসিবাদী অপশক্তি তাদের শাসনকে পোক্ত করতে এখানকার ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতনের মাত্রা তীব্রতর করে রেখেছিল পুরো শাসনকালে। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে পতনের আগ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন বছরের পর বছর। প্রায় ১৪ শ’ মামলার বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়েছে লক্ষাধিক গণতন্ত্রকামীকে। চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের ৩০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে। আবার কাউকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। এমনকি অমুসলিম পুলিশ কর্মকর্তার মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত শিবিরকর্মীকে গুলি করার মতো ঔদ্ধত্যের ঘটনাও ঘটেছে। এখনো ফেরেননি আরো অনেকের মতো গুম হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম বাচা চেয়ারম্যান। অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের আমলে অনেক মামলায় এখনো হাজিরা দিতে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয় অসংখ্য বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীকে। সে সময়ে দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলাই ছিল গায়েবি মামলা। কল্পিত ঘটনা বর্ণনা করেই রুজু করা হয় নাশকতার মামলা। প্রায় ১৪ শ’ মামলার অধিকাংশেই আসামি করা হয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, যুবদলের নেতাকর্মীদের।

বিএনপির পক্ষ হতে দাবি করা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরী, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা মিলিয়ে দলটির ১৭ জন নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। আবার কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম কোস্টার হেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদ জানে আলম জুনু, মিরসরাইয়ের সাহেবখালীর বুমখালির বিএনপি কর্মী হাফেজ উদ্দিন জসীমকে গুম করা হয়। এ ছাড়া হত্যার শিকার হন শ্রমিক দল নেতা শহীদ আব্দুল কাদের মিলন, পাহাড়তলী সেগুনবাগানের শাহ আলম মনু, হালিশহরের বিএনপি নেতা শহীদ খোকন মাঝি, সীতাকুণ্ডের জাফরনগরস্থ সৈয়দপুরের শহীদ আহমেদুর রহমান, সীতাকুণ্ডের পশ্চিম লালানগরের যুবদল কর্মী আবুল হোসেন, সন্দ্বীপের সাবেক কমিশনার মো: কাউছার, ফটিকছড়ির দাঁতমারার বিএনপি নেতা শহীদ আবদুল গণি, ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরের শহীদ ফোরকান উদ্দিন, সাতকানিয়ার ছদাহা আফজল নগরের বিএনপিকর্মী শহীদ ওসমান গনি। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালামকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে খুন করে। গুম হয়েছেন ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আলম সিরাজ, বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচা। অন্যদিকে সীতাকুণ্ড পৌরসভার ইয়াকুব নগরের নুরুজ্জামান খোকন (পঙ্গু), সীতাকুণ্ডের কুমিরা নিমতলার মো: হায়সাম সিদ্দিকী জনি (মারাত্মক আহত), সীতাকুণ্ডের বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের বহরপুর গ্রামের মো: সোহেল (পঙ্গু)। কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন মোহরা ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমান। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুরের বিএনপি নেতা জামসেদ উদ্দীন ও বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন বিএনপি নেতা নুরুল মোস্তফা বজলকে খুন করা হয়।

জামায়াতে ইসলামীর আইন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হয় ১১০৪টি ফৌজদারি মামলা। এসব মামলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিএনপি নেতাকর্মীরাও আসামি। একেকটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২০ থেকে দুই হাজার জন পর্যন্ত। সব মিলিয়ে এসব মামলায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ জামায়াত নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক এমপি মাওলানা শামসুল ইসলাম ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে ৮৬টি করে মামলায়। ছাত্রশিবিরের কোন কোন নেতাকে আসামি করা হয়েছে পাঁচ ডজন পর্যন্ত মামলায়। ফ্যাসিস্ট সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সক্রিয় নেতাকর্মীদের দিন কেটেছে হয় জেলে, নয়তো হাজিরা দিতে আদালতে আসা-যাওয়ায়। আবার কোনো কোনো নেতার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের জামিন আদেশকেও অগ্রাহ্য করে আবার নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বছরের বছরের কারাগারে থাকতে বাধ্য করা হয়।

ফ্যাসিবাদী আমলে চট্টগ্রামে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের যেসব নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন তাদের ঘটনা মর্মান্তিক। ২০১০ সালের ১১ মার্চ ষোলশহর রেলস্টেশনে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে চবি শিবিরকর্মী কক্সবাজারের চকরিয়ার মহিউদ্দিন মাসুমকে। একই বছরের ২৮ মার্চ ষোলশহর রেলস্টেশনে হত্যা করা হয় চবির আরেক শিবিরকর্মী মিরসরাইয়ের শহীদ হারুনুর রশিদ কাউসারকে। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চবিতে নৃশংস কায়দায় খুন করা হয় শিবিরকর্মী শহীদ মাসুদ বিন হাবিবকে। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে। একই দিনে খুন করা হয় আরেক শিবিরকর্মী শহীদ মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদকে। মুজাহিদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর দেওয়ানহাটে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জামায়াতকর্মী শহীদ শফিকুল ইসলাম। একই দিনে সেখান থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে তুলে দিলে চোখ উপড়িয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয় নগরীর হালিশহর এইচ ব্লকের শিবিরনেতা শহীদ আবিদ বিন ইসলামকে। এ ছাড়াও সেখানে পুলিশের গুলিতে খুন হন জামায়াতের সহযোগী সদস্য উত্তর কাট্টলীর শহীদ আফজাল আহামদ। একই দিনে নগরীর অলঙ্কার মোড়ে দুপুরে শিবিরের সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করে শিবিরকর্মী ছোটপুল ব্রিকফিল্ড রোডের শহীদ এমরান খান রাজিবকে।

২০১৩ সালের ১ মার্চ জামায়াতের মিছিল শেষে বাড়ি ফেরার পথে নগরীর চকবাজারে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় খুন হন জামায়াতের সহযোগী সদস্য আনোয়ারা বরুমচড়ার শহীদ হাফেজ মো: হারুন। একই বছরের ২২ মার্চ জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীকে গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশ বাসার ছাদ থেকে ফেলে দিলে শহীদ হন শিবিরকর্মী সাতকানিয়ার শহীদ মাঈনুদ্দীন হাসান মুন্না। একই বছরের ৩১ মার্চ খুন করা হয় সীতাকুণ্ডের জামায়াতকর্মী শহীদ রেজাকুল হায়দারকে। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি ছাত্রলীগের পিশাচরা চবির শাহ আমানত হলে কুপিয়ে এবং গলা কেটে খুন করে শিবির নেতা শহীদ মামুন হোসাইনকে। মামুনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি বায়তুশ শরফ মাদরাসা থেকে ফেরার পথে নগরীর কদমতলী মোড় হতে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতনে শহীদ হন শিবির নেতা লোহাগাড়ার পুটিবিলার সাকিবুল ইসলাম। এ ছাড়া একই বছরে নগরীর চকবাজারের বাসায় হামলা করে পুলিশ বাসার ছাদ থেকে ফেলে দিলে শহীদ হন অ্যাডভোকেট জাহেদ মাহমুদ নামের এক জামায়াত কর্মী। অ্যাডভোকেট জাহেদের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির বাবুনগর বোর্ডস্কুল গ্রামে।

বিভীষিকাময় ওই সময়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ছাত্রশিবির নেতা খুলসীর আবু সাইয়েদ মুতী, রামপুরের জিল্লুর রহমান, জামায়াত নেতা মিরসরাই দুর্গাপুরের মফিজুর রহমান, চান্দগাঁও পাঠানপাড়ার সোলায়মান খান, জামায়াত কর্মী চান্দগাঁওয়ের সাইফুল ইসলাম, পশ্চিম মোহরার নজরুল ইসলাম, চান্দগাঁওয়ের সরওয়ার আলম এবং রাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগরের সাইফুল ইসলাম, নগরীর চন্দনপুরার শিবিরকর্মী বাহার উদ্দিন, শিবিরকর্মী তাফসিরুল মু’মিনীন এবং জামায়াতকর্মী সালাহ উদ্দিন।

সে সময়কার চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির ও বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শাহজাহান নয়া দিগন্তকে বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলের পুরো সময়টা বাংলাদেশের জন্য অন্ধকার যুগ ছিল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল। জাতীয় নির্বাচনগুলো ছিল তামাশার এবং প্রতারণা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিরোধী মত-পথের ওপর দমন পীড়ন, মিথ্যা মামলা, গুম-খুন ছিল ফ্যাসিবাদীদের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। ক্ষমতার শতভাগ অপব্যবহার করে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে শতভাগ চেষ্টা করলেও অবশেষে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী অপশক্তির লজ্জাজনক পতন হয়েছে। এই চট্টগ্রাম মহানগরীতে নিজের দায়িত্ব পালনের সময়ে পরিচিত কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতাকর্মী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পরিবার পরিজন ছেড়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। একেক জনের বিরুদ্ধে এক শ’ মিথ্যা মামলা পর্যন্ত রুজু করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কঠিন নির্যাতনের মাঝে চট্টগ্রাম মহানগরের সর্বস্তরের জনশক্তি নজিরবিহীনভাবে সংগঠিত ছিল এবং আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত ছিল।

বিভীষিকাময় সময়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা: শাহাদাত হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনের সাড়ে ১৫ বছর নিষ্পেষণ, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, হামলা, গুপ্তহত্যা ও গুমের ঘটনাগুলো ছিল একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। কারাগারই ছিল বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ঠিকানা। নির্বাচনগুলোকে তারা তামাশায় পরিণত করেছিল। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ১০৫ মামলার আসামি এই বিএনপি নেতা বলেন, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা আওয়ামী লীগকে এদেশের মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না। বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের এখনো বহু মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল। পুরো সময়জুড়ে লুটপাট-দুর্নীতি এবং মানুষের অধিকার খর্বের বাজে রাজনীতিই তারা (আওয়ামী লীগ) করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তিনি ফ্যাসিবাদী আমলের মেগা দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি জানান।