পতিত আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত লুটেরাদের থাবায় তছনছ হয়ে পড়েছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে বের করে নিয়েছিল ৪ লাখ কোটি টাকা। এসব অর্থ আর ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের কলঙ্ক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম একাই নিয়েছে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থের বেশির ভাগই দেশ থেকে পাচার করে দেয়া হয়েছে। রাতের অন্ধকারে একে একে ৮টি ব্যাংক দখল করে রেখেছিল এস আলম। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এসব ব্যাংক দখল করার পর সাধারণের আমানতের অর্থ পানির মতো বের করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে পালিয়ে যায় এস আলমসহ অনেক ব্যাংক লুটেরা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনের হাত দেয়। এস আলমের দখলে থাকা ৮টিসহ মোট ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়। শুরু হয় ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ বের করতে বিশেষ তদন্ত। এসব তদন্তে একে একে ব্যাংক লুটের তথ্য বের হতে থাকে। এতেই বের হয়ে আসে ব্যাংক লুটের ভয়াবহ তথ্য। আগ
গতকাল অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকে এক অনুষ্ঠানে এসে বলেছেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সবার জন্য সমান সুযোগ ছিল না। দুর্নীতি ছিল চূড়ান্ত পর্যায়। গুটি কয়েক লোক আর্থিক খাত ধ্বংস করে দিয়েছে। যে ব্যাংকের মালিক, সে এমপি, হোটেলের মালিক, টেলিভিশনের মালিক ছিল। সবই ছিল একচ্ছত্র। এটা থেকে এখন মুক্ত, তবে আসল মুক্ত হবো, যখন এটা পুনরায় না হয়। সবাই যেন সুযোগ পায়। তিনি বলেন, আমরা অল্প সময়ের জন্য এসেছি। কিছুটা চেষ্টা করেছি সংস্কার করার জন্য। ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠান, প্রক্রিয়া ও মানুষ সব নষ্ট হয়ে গেছে। এত বছরের পাথর সরাতে সময় লাগবে। কাকে দিয়ে কাজ করাবো এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর মধ্যেও সোনার মানুষ আছে। এসব মানুষ নিয়ে সংস্কার করতে হবে। আর্থিক খাত মোটামুটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ খাত আইসিউতে ছিল, সেখান থেকে আরো আগে বেরিয়ে এসেছি। এখন কেবিন থেকে বাড়ি ফিরে আসছে। এবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় লুটেরা ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। অর্থনীতির অভিশাপ এই এস আলম পতিত সরকারের সহযোগিতায় একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকে পাচার করেছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। যার বড় একটি অংশই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি ও স্টার্ক ব্যাংকার্স ফোরামের নেতারা জানিয়েছিলেন, পতিত সরকারের আমলে দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
১০ প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা : ৫ আগস্টের পর অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে তদন্তের আওতায় এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে আলোচিত ১০ প্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খেকো এস আলমই হাতিয়ে নিয়েছেন সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। আর আরেক ব্যাংকখেকো সালমান এফ রহমান নিয়েছেন ৫৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংক থেকে টাকা লুটের তথ্য আরো বাড়তে পারে। এসব অর্থের বেশির ভাগ অংশই পাচার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেলকো অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, আলোচিত ১০টি কোম্পানি সুকৌশলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা বের করে নিলেও তা দেশে বিনিয়োগ না করে বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী একাধিক সংস্থা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আলবেনিয়া, সাইপ্রাস, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ডোমেনিকা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইমান আইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ব্যাংক খেকো এস আলম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন রেহেনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে এস আলম ছিলেন অতি আপনজন। দেশের ব্যাংক খাত খালি করে তাদের অর্থের জোগান দেয়া হতো। পাশাপাশি নিজেও হাতিয়ে নিয়েছেন জনগণের অর্থ। একপর্যায়ে শেখ পরিবারের সবচেয়ে নির্ভরশীল অর্থের জোগানদাতা হয়ে ওঠেন ব্যাংক ডাকাত এস আলম। আর এ কারণে একে একে দেশের প্রতিষ্ঠিত আটটি ব্যাংক এস আলমের একক মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয়। এজন্য রাতের অন্ধকারে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যদেরকে দিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত মালিকদের বন্দুকের ডগার মুখে ব্যাংক হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংককে মাত্র এক দিনের মধ্যে তৎকালীন এমডি ও চেয়ারম্যানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে ব্যাংক হস্তান্তর কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।
ইসলামী ব্যাংক দখলে নিয়েই ব্যাংকটি থেকে পানির মতো অর্থ বের করে নিয়ে যান সাইফুল আলম। এভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ আটটি ব্যাংক দখলে নেন এস আলম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে সরাসরি সহযোগিতা করে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিনসহ প্রায় ডজন খানেক কর্মকর্তা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। যেখানে টাকা লুটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেকটা নিরুপায় হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে এস আলম হাতিয়ে নিয়েছেন ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে থাকা তার সব সম্পদ ইতোমধ্যে বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র পরিচালক দ্বারা ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে। লুটপাটের শিকার হয়ে ব্যাংকগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাদে এখন গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না অন্য ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে আরেক ব্যাংক খেকো সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়ে নিয়েছেন ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এটাও প্রাথমিক হিসাব। প্রকৃত হিসাবে আরো ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংস্থাগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের প্রাথমিকভাবে দেশ থেকে টাকা পাচারের তালিকার মধ্যে অন্য আটটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপ। গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কিছুদিন পরপর নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তুলে শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে সরবরাহ করতেন এই নজরুল ইসলাম মজুমদার। বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিদের ব্যাংকের পেঅর্ডার নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিতরণ করতেন। তিনি নিজেও সফেদ পাঞ্জাবি পড়ে ছবি তুলে ব্যাংকের অর্থে তা আবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপাতেন। বিশেষ করে আওয়ামী অনুগত মিডিয়াগুলোতে বড় আকারে এসব ছবি ডিসপ্লে করতেন। আর এ সুবাদে তিনি এক্সিম ব্যাংকে অনেকটা আজীবনের জন্য চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। দখল করে ছিলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যানের পদটিও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে নজরুল ইসলাম মজুমদার দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়েছেন ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
এসব অর্থের বড় একটি অংশ পাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ প্রায় আটটি দেশে নজরুল ইসলাম মজুমদারের অর্থ পাচারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অর্থ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিকদার গ্রুপ ৬ হাজার কোটি টাকা, সামিট গ্রুপের নামে ৭ হাজার কোটি টাকা, বসুন্ধারা জেমকন গ্রুপের নামে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান বাবুর কোম্পানি আরামিট গ্রুপের নামে ৮০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে পাচারের তালিকায় ওরিয়ন গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপেরও নাম রয়েছে।
৫ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ : পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এক দিকে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের নামে বের করে নেয়া হতো, আবার ওইসব ঋণ পরিশোধ করা হতো না। শুধু তাই নয়, গোপন করা এসব ঋণখেলাপি হিসেবেও দেখাত না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও এসব অর্থ বের করা হতো না পতিত সরকারের ভয়ে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে এসব ঋণের তথ্য বের হতে থাকে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ থেকে ৪ শতাংশ দেখানো হতো, ওইসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ৯৮ শতাংশে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছেড়ে গেছে। জুনের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হিসাবে আরো বাড়তে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে।
১৪ প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পুনর্গঠন : গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সব লুটেরাই পালিয়ে গেছে। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই ব্যাংকিং খাতের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয়। বিশেষ অধ্যদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে বসানো হয় ড. আহসান এইচ মনসুরকে। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি ব্যাংকিং খাত সংস্কারের হাত দেন। এস আলমের দখল করা ৮টিসহ একে একে ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেন। নতুন পর্ষদের অধীনেই ব্যাংকগুলো গত এক বছর ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে।