দিনে বাড়তি মিলবে দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস

হবিগঞ্জ ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভার কাজ শুরু

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নতুন আশার বার্তা নিয়ে আবারো শুরু হলো হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম। সফলভাবে এই কাজ শেষ হলে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন আরো দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। যা প্রায় ৯ কোটি টাকার এলএনজি মূল্যের সমান। এক বছরের হিসেবে তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা এবং সাত বছরের হিসেবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নতুন আশার বার্তা নিয়ে আবারো শুরু হলো হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম। সফলভাবে এই কাজ শেষ হলে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন আরো দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। যা প্রায় ৯ কোটি টাকার এলএনজি মূল্যের সমান। এক বছরের হিসেবে তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা এবং সাত বছরের হিসেবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমনিতেই স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদন কমে আসছে সেই সাথে কমছে মজুদও। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়লে স্বস্তি মিলবে অর্থনীতিতে।

বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো: ফারুক হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ৫ নং কূপ থেকে বর্তমানে গড়ে এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। এরই মধ্যে এ কূপে পানি আসছিল। সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে প্রতিদিন বাড়তি দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস মিলবে। আশা করি এভাবে এ কূপ থেকে সাত থেকে আট বছর গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে।

ওয়ার্কওভার কার্যক্রমের লক্ষ্য ও প্রেক্ষাপট : বিজিএফসিএল জানায়, তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা গ্যাস ফিল্ডের সাতটি কূপে ‘ওয়ার্কওভার’ শীর্ষক চলমান প্রকল্পের অংশ হিসেবে হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পুরনো ও কম উৎপাদনক্ষম কূপগুলোকে ফের সক্রিয় করে উৎপাদন বাড়ানো এবং জাতীয় জ্বালানি সরবরাহে অবদান বৃদ্ধি। ইতোমধ্যেই ওয়ার্কওভার কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো: ফারুক হোসেন, পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (আরডিএম), বিজিএফসিএল এবং বাপেক্সের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ডিসেম্বরেই শেষ হবে কাজ : বিজিএফসিএল জানিয়েছে, ওয়ার্কওভার কার্যক্রমটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সফলভাবে কাজ সম্পন্ন হলে জাতীয় গ্রিডে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে যা দেশের বর্তমান গ্যাস সঙ্কট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের সাতটি কূপ থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শেষ হলে এই সরবরাহ আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

কূপের ইতিহাস ও প্রযুক্তিগত তথ্য : হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপটি ১৯৮৮ সালে তিন হাজার ৫২১ মিটার গভীরতায় খনন করা হয়। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কূপটি থেকে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই কূপটি দেশের শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গৃহস্থালী খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবহারে গ্যাস চাপ ও উৎপাদন হার ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

ওয়ার্কওভার কী ও কেন প্রয়োজন : ওয়ার্কওভার কার্যক্রম হলো এমন একটি প্রকৌশল প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পূর্বে খননকৃত বা ব্যবহৃত গ্যাস কূপে নতুন করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যান্ত্রিক ও ভূতাত্ত্বিক কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কূপ পরিষ্কারকরণ, নতুন লাইনার স্থাপন, অবরুদ্ধ স্তর আবারো খোলা, অথবা নতুন উৎপাদন স্তরে প্রবেশ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্যাসের প্রবাহ ফের স্বাভাবিক করা যায় এবং পুরনো কূপগুলো থেকে আবারো বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হয়।

জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্ব : বাংলাদেশে গ্যাস হলো দেশের প্রধান জ্বালানি উৎস। বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প কারখানা, সার কারখানা, এমনকি গৃহস্থালী রান্নায়ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন হ্রাস ও নতুন অনুসন্ধান কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে দেশ ক্রমবর্ধমানভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর পুরনো কূপে ওয়ার্কওভার কার্যক্রমকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার ও পেট্রোবাংলা। এতে একদিকে উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম, অন্যদিকে স্বল্প সময়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাবনা : হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপ থেকে অতিরিক্ত দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা গেলে শিল্প খাতে জ্বালানি সঙ্কট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। বিশেষ করে সার, বিদ্যুৎ এবং বস্ত্রশিল্পে গ্যাস সরবরাহে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ প্রতি হাজার ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৬০ টাকা। এ হিসেবে দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাসের দাম এলএনজিতে স্থানান্তর করলে হবে প্রায় ৯ কোটি টাকা, বছরে যা ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা এবং সাত বছরে হবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি পরিকল্পিতভাবে পুরনো কূপগুলোতে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি ব্যয় সাশ্রয় করতে পারবে।

হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির নয়, বরং জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদারের দিকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদি পরিকল্পনামাফিক এই কাজ সফলভাবে শেষ হয়, তবে তা দেশের গ্যাস উৎপাদন সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে একটি সফল মাইলফলক হয়ে উঠবে।