ঢাকায় অরাজকতার নীলনকশা

আব্দুল কাইয়ুম
Printed Edition
  • ৪টি বাসে আগুন, বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ
  • শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘিরে নাশকতার শঙ্কা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা গণহত্যা মামলার রায় ঘোষণা ও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে গতকাল সোমবার সকালে মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ধানমন্ডির দুই জায়গাসহ কয়েক স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের পাশাপাশি চারটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সব জায়গাতেই মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে আসা ব্যক্তিরা ককটেল ছোড়ে। পুলিশ বলেছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে নাশকতা ও অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

পুলিশের সূত্র জানায়, একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের অংশবিশেষ সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে, যার লক্ষ্য হতে পারে অরাজকতা সৃষ্টি করা। তা ছাড়া বৃহস্পতিবারের রায়কে কেন্দ্র করে ব্যাপক নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার নীলনকশা এঁকেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ। দলটির মধ্যম সারির কিছু নেতা দেশব্যাপী লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের মূল লক্ষ্য সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা, আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো।

ডিএমপি জানায়, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘোষিত ১৩ নভেম্বরের লকডাউন কর্মসূচির দু’দিন আগেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে ঢাকায়। দলটির পক্ষ থেকে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ফেসবুকে নানা ধরনের প্রপাগান্ডা ও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। সবাই সেটা দেখছেন। এরই অংশ হিসেবে ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কাজের চেষ্টা চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঢাকা মহানগর পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থেকে নগরবাসীর নিরাপত্তায় কাজ করছে।

এ দিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতর বা বাইরে থেকে নাশকতার চেষ্টা চালানো হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণকে সাথে নিয়ে যেকোনো অপচেষ্টা মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া রায় ঘোষণার সময় রাজনৈতিক উত্তেজনা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এতে যদি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী সুযোগ নেয়, তাহলে তা দেশের নিরাপত্তা ও ভাবমর্যাদার জন্য বড় ঝুঁকি হবে।

রাজধানীতে ৪ বাসে আগুন : সোমবার সকালে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায় ভিক্টর পরিবহনের দু’টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বাসে আগুনের আরেকটি ঘটনা ঘটে মেরুল বাড্ডার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সকাল সোয়া ছয়টার দিকে যাত্রীবাহী আকাশ পরিবহনের বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ছাড়াও ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। বাসে আগুনের খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশন থেকে দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনে। বাসটি শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে জানা গেছে।

প্রবর্তনার সামনে ও সীমানার ভেতরে ককটেল বিস্ফোরণ : গতকাল সকাল ৭টার দিকে মোহাম্মদপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারের খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান প্রবর্তনার সামনের সড়কে ও সীমানার ভেতরে দু’টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। দু’জন ব্যক্তি হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বলে জানিয়েছেন প্রবর্তনার এক নিরাপত্তাকর্মী।

মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের সামনে ককটেল : গতকাল ভোর রাতে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান শাখার সামনের রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, মোটরসাইকেলে এসে দুই ব্যক্তি এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। তাদের মাথায় হেলমেট ছিল, চেহারা বোঝা যায়নি।

ধানমন্ডির দুই জায়গায় বিস্ফোরণ : ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাইডাস সেন্টারের সামনে দু’টি এবং ৯/এ সড়কে ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে দু’টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সকাল পৌনে ৭টা থেকে ৭টার মধ্যে এসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, একটি মোটরসাইকেলে দু-তিনজন এসে দু’টি ককটেল ছোড়ে। বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরণে আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

আগারগাঁও রেডিও স্টেশনের সামনে বিস্ফোরণ : গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও রেডিও স্টেশনের সামনে মোটরসাইকেলে করে এসে দু’টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

পুলিশের বক্তব্য : পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা মূলত আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করছি। সব ধরনের নাশকতা এড়াতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ। তবে ১৩ তারিখের রায়কে কেন্দ্র করেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সোমবারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে চেকপোস্ট স্থাপনসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের ধারণা যারা লকডাউন ডেকেছে তারাই ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাতে পারে। এসব দুষ্কৃতকারী সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করার জন্য এসব করছে। আমরা পর্যাপ্ত পুলিশের ব্যবস্থা রেখেছি এসব মোকাবেলা করার জন্য। ১৩ নভেম্বরকে ঘিরে ফেসবুক-ইউটিউবে আমরা নানা ধরনের তথ্য পাচ্ছি। এসব তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কয়েক দিন ধরে সক্রিয়। রাজনৈতিক দলগুলোও মাঠে থাকবে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

ষড়যন্ত্রে যুক্ত পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠরা : নিরাপত্তা সূত্রে জানা গেছে, ষড়যন্ত্র পরিকল্পনার সমন্বয় করা হচ্ছে প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে। ঢাকায় নাশকতার পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে, যিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলাম ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তাও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত বলে দাবি সূত্রের। তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন পলাতক সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত শিকদার, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবং যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাছাইকৃত কর্মীদের ঢাকায় আনছেন বতথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি ঢাকায় একটি অস্ত্রের চালান আটক করেছে সেনাবাহিনী। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আরো কয়েকটি চালান দেশে ঢুকতে পারে। এছাড়া আগের সরকার আমলে দলীয় বিবেচনায় দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্সগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এখনো জমা হয়নি। এসব অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে ইতোমধ্যে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।

সরকারের কঠোর অবস্থান : এদিকে রাজধানীতে সাম্প্রতিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সাথে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে যেকোনো অপচেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার।

গতকাল প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, রাজধানীতে সম্প্রতি ককটেল হামলার ঘটনায় ২৮ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। প্রাথমিক তদন্তে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে কাকরাইলের সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল এবং সেন্ট জোসেফ স্কুল প্রাঙ্গণে ককটেল বিস্ফোরণসহ একাধিক ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিএমপি এই জঘন্য ও কাপুরুষোচিত সহিংসতায় জড়িত প্রত্যেককে গ্রেফতারের জন্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাথে সমন্বয় করে শহরজুড়ে অভিযান জোরদার করেছে। রাজধানীর সব গির্জা এবং সব ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আন্তঃধর্মীয় ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে। ধর্মীয় সহাবস্থানে কোনোরূপ বিঘœ ঘটানোর চেষ্টা হলে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হবে।