দক্ষিণ এশিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ভারত

গণতান্ত্রিক চরিত্র বৃহৎ ভারতকে প্রায় ৮ দশক ধরে একত্র করে রেখেছে। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ। অটল বিহারি বাজপেয়ি অযোধ্যা যাত্রার মাধ্যমে যে গেরুয়া পতাকা তুলে ধরেছিলেন, তার ফল স্বৈরাচারী মোদির উত্থান।

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয় |সংগৃহীত

এলবার্ট পি. কষ্টা

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি সম্ভবত পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে দ্রুত মেরুকরণের পথে হাঁটছে। এ অঞ্চলের শক্তিশালী ভারত আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিশীল মনে হলেও দেশটি বেশ ঝুঁকির মধ্যে আছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত এমন বহুমুখী সঙ্কটে আর পড়েনি। বিশেষ করে বাণিজ্য, কূটনীতিক, সামরিক এবং অভ্যন্তরীণ এ চারটি খাতে একই সময়ে এমন বিরূপ পরিস্থিতি ভারতকে আর কখনো মোকাবেলা করতে হয়নি।

বাণিজ্য

ভারতের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার বাণিজ্যে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার জের ধরে ৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক ভারতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বহির্বিশ্বে বাণিজ্যিক কার্যক্রম যত অল্প সময়ে একের পর এক ভারতের বিপক্ষে চলে গেছে ঠিক তত দ্রুত দিল্লি বিকল্প বাজার সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে শত শত মিল কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্টস ও পর্যটন শিল্প তীব্র সঙ্কটে পড়েছে। হাজারো মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ভয়াবহ বিপর্যয়ে। ক্ষমতাসীনরা আদানির মতো অলিগার্কের সাথে এমন বাণিজ্যিক নেক্সাস তৈরি করেছে, যা প্রান্তিক কৃষক শ্রমিকের জীবনমান সহনীয় রাখা ক্রমে অসম্ভব করে তুলছে।

কূটনীতি

ভারত গত এক দশক ধরে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর প্রধান কারণ, বর্তমান সরকারের অদূরদর্শিতা। স্বাধীনতার পর নেহরুর নেতৃত্বে ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্ব কূটনীতিতে নিজেকে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। ভারতের কূটনৈতিক সক্ষমতা শীতল যুদ্ধের সময় দেশটিকে সুরক্ষা দিয়েছে, ব্যাপক বৈদেশিক সুবিধাও এনে দিয়েছে। রাশিয়ার সাথে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী, শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি এবং পাকিস্তানের সাথে শিমলা চুক্তি ভারতকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নেয়া ‘নেইবার ফার্স্ট’ কূটনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একেবারে বন্ধুহীন করে তুলেছে। এ অঞ্চলের সর্বশেষ বন্ধু বাংলাদেশ ২০২৪ সালে হাসিনা পালানোর মধ্য দিয়ে হাতছাড়া হয়ে যায় ভারতের। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় দাদাগিরি করার যে তালুকদারি দিয়েছিল ভারতীয় কূটনৈতিক অক্ষমতায় তাও কেড়ে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

সামরিক

প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধের আতঙ্কে ভুগছে ভারত। ’৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধ ও ৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এত বড় সামরিক বিপর্যয়ে পড়েনি দেশটি। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শোচনীয় অবস্থা হয় দিল্লির। বিশেষ করে যেভাবে ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে হয়েছে সে ট্রমা, ভারতের পিছু ছাড়বে না বহুকাল। ভারতীয় জনগণের মাঝে সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের যে মিথ গড়ে উঠেছিল তা যেন কর্পূরের মতো মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আক্রমণ দূরে থাকুক, আত্মরক্ষার সক্ষমতা নিয়ে বিচলিত ভারত। সম্প্রতি একটি সেমিনারে বাংলাদেশকে যে ভারত সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভয় পাচ্ছে, সে কথাও উঠে এসেছে ভারতীয় জেনারেলদের বক্তব্যে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের সামরিক ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছিল। এতে ভারতের চীনা ফ্রন্ট মোকাবেলা সহজ হয়। এখন জেনারেলরা বাংলাদেশ ঘিরে ইস্টার্ন কমান্ডে নতুন করে ডিপ্লয়মেন্টের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতকে তৃতীয় ফ্রন্ট খুলতে হচ্ছে। চীনের সাথে উত্তেজনা কমাতে তাই নরেন্দ্র মোদি ছুটে গেছেন বেইজিংয়ে। রাজি হয়েছেন চীন-রাশিয়া জোটে যোগ দিতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ বাংলাদেশে শুরু হলে এবং বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিস্থিতি তৈরি না হলে ভারতকে এ অঞ্চলে তৃতীয় ফ্রন্ট খুলতে হবে। এতে করে ভারতের সামরিক ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা কঠিন। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে বৈরী সরকার গঠিত হয় কি না তা নিয়েও ভারতের তরফে অস্বস্তি আছে।

অভ্যন্তরীণ

এ মুহূর্তে ভারতকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও সামরিক ও রাজনৈতিক দু’টি চাপ সামলাতে হচ্ছে। পাঞ্জাবের খালিস্তান আন্দোলন, নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন এবং কাশ্মিরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ হটানোর পর উদ্ভূত কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামীদের প্রচণ্ড চাপ সামরিকভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কাশ্মিরে ভারতীয় ইতিহাসের সর্বাধিক সৈন্য মোতায়েন আছে। নাগাল্যান্ডেও বিপুল সেনা মোতায়েন রাখতে হয়েছে। কৃষক অসন্তোষ ভারতে নতুন কিছু নয়। ষাটের দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে শুরু করে কিছু দিন আগে দিল্লি ঘেরাও পর্যন্ত ভারত সরকারকে নৃশংসতার মাধ্যমে থামাতে হয়েছে। সম্প্রতি বিহারে চাকরির দাবিতে জেনারেশন-জি মাঠে নেমেছে। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ ও সম্প্রতি নেপালের ঘটনাবলী ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে। জ্বালানি তেল ব্যবহারের যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে ভারত তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে দেশব্যাপী যে কোনো মুহূর্তে জেন-জি’র প্রতিরোধে পড়তে পারে দেশটি।

গণতান্ত্রিক চরিত্র বৃহৎ ভারতকে প্রায় ৮ দশক ধরে একত্র করে রেখেছে। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ। অটল বিহারি বাজপেয়ি অযোধ্যা যাত্রার মাধ্যমে যে গেরুয়া পতাকা তুলে ধরেছিলেন, তার ফল স্বৈরাচারী মোদির উত্থান। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, ভারতীয় ইনস্টিটিউশনগুলোর ভিত্তি অনেক গভীরে। এখানে গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাহুল গান্ধী ‘মৃত ভোটারদের’ সাথে চা খাচ্ছেন। ১২ ফুট বাই ১৫ ফুট ঘরের ঠিকানায় ৪০ জন রেজিস্টার্ড ভোটার রয়েছে, যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী এক বছরের প্রচেষ্টায় শুধু একটি নির্বাচনী আসনে দুই লাখ ভোটারের গরমিল মিডিয়াতে হাজির করেছেন। বোঝাই যায়, দৃশ্যত ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে অথবা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় জনগণের হাতে থাকে অভ্যুত্থান বা বিপ্লব। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারত ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বছরখানেক আগে। উপমহাদেশজুড়ে পাকিস্তানসহ সব প্রতিবেশী এ মুহূর্তে ভারতের বৈরী। শুধু রাষ্ট্র নয়, এর নাগরিকদের বড় অংশ ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন।

লেখক : রাজনীতিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন