পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বিচারিতা

আজ যদি ব্যক্তি, জাতি ও বিশ্ব কল্যাণ চায়, তবে ফিরে যেতে হবে সেই সভ্যতায়, যেখানে কামনা নয়, ছিল কোরবানি; যেখানে প্রবৃত্তি নয়, ছিল আত্মসংযম; যেখানে ছিল আল্লাহভীতির নির্মল শুদ্ধতা।

ডা. মো: এনামুল হক

ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলা মানুষ আজ আর পেছনে তাকাতে চায় না। সভ্যতা শব্দটি উচ্চারিত হলে আমাদের কল্পনায় উঠে আসে সুউচ্চ অট্টালিকা, তীব্র গতির প্রযুক্তি, বিলাসী জীবনধারা আর বিকশিত জ্ঞানবিজ্ঞান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এগুলোই কি সভ্যতার পূর্ণ পরিচয়? নাকি এগুলো কেবল তার চামড়ার মতো, যার নিচে লুকিয়ে আছে একটি গভীর অন্তঃসত্ত্বা?

সভ্যতা, এই শব্দটি কেবল বস্তুগত অগ্রগতির ফর্দ নয়। সভ্যতা মানে মানুষের মনোজগতের পরিপক্বতা, সামাজিক সৌহার্দ্য, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্যাণবোধের একটি সমবেত রূপ। আলবেরুনি সভ্যতাকে বলেছিলেন, ‘মানুষের সম্মিলিত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ’, আর দার্শনিক ইবনে খালদুন বলেছিলেন, ‘সভ্যতা মূলত আত্মার পরিশীলন’। এই আত্মিক পরিশীলনের দৃষ্টিতে আমরা যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে তাকাই, তখন অট্টালিকার ভিড়ে, পরমাণু অস্ত্রের ছায়ায়, আর জৈবিক আকাক্সক্ষার কল্লোলে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে এক ভিন্ন চিত্র, যেখানে প্রগতি আছে; কিন্তু প্রাণ নেই; গতি আছে, কিন্তু গন্তব্য নেই।

সভ্যতা হলো মানুষের আত্মিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সম্মিলিত রূপ। এটি কেবল অবকাঠামো নয়; বরং মানুষের চিন্তা, দর্শন, ভাষা, নীতি ও সৌন্দর্যবোধের সমন্বিত প্রবাহ। সে কারণে সভ্যতা বিশ্লেষণে আত্মার প্রশ্ন আসে, হৃদয়ের প্রশ্ন আসে, আসে সত্য ও কল্যাণের সংজ্ঞা।

পাশ্চাত্য সভ্যতা দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে র‌্যাশনালিজম (যুক্তিবাদ) ও ন্যাচারালিজমের (প্রকৃতিবাদ) ওপর দাঁড় করিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। তারা যুক্তি ও প্রকৃতিকে বলেছে সর্বোচ্চ মানদণ্ড। কিন্তু এই যুক্তি ও প্রকৃতির ব্যাখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের চরম দ্বিচারিতা। সামাজিক ক্ষেত্রে, তারা বলে, মানবাধিকারের সর্বোচ্চ মানদণ্ড পাশ্চাত্যের। অথচ ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া যেখানেই পৌঁছেছে পাশ্চাত্যের ‘সভ্যতা রফতানি’, সেখানেই পাওয়া গেছে ধ্বংসস্তূপ, বৈষম্য ও রক্তাক্ত ইতিহাস।

রাজনীতিতে, তারা গণতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চালায়, অথচ নিজের রাষ্ট্রে ডিপ স্টেট, করপোরেট লবিং আর মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে জনগণের মতপ্রকাশের অবকাশই থাকে না। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে স্বৈরশাসকদের টিকিয়ে রাখতে মরিয়া আর তৃতীয় বিশ্বের গরিব-উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে হানাহানি, সা¤্রাজ্যবাদ কায়েম। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তারা ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র নামে অশ্লীলতা ও মূল্যবোধ-ধ্বংসকে উৎসব করে তোলে, অথচ নিজের ভেতরে নারীবাদ ও যৌন পরিচয় প্রশ্নে এমন সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যা গোটা সভ্যতাকে পরিচয় সঙ্কটের অতল গহ্বরে ফেলে দিয়েছে।

পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্র এক দিকে বিজ্ঞানের পূজারী হয়ে যুক্তি ও প্রকৃতিকে অবলম্বন করার কথা বলে; কিন্তু বাস্তবে মিথ, আধ্যাত্মিকতা, অতিপ্রাকৃতা, ভবিষ্যদ্বাণী, অলৌকিকতা, পুনর্জন্ম ইত্যাদির আশ্রয় নেয়। এ এক মনস্তাত্তি¡ক দ্বিচারিতা, যেখানে পাশ্চাত্যের আত্মা আজো ঈশ্বর ও যুক্তির মাঝখানে দ্বিধান্বিত। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিমা চেতনায় যুক্তিবাদ আর প্রকৃতিবাদ অনেকটা বাহ্যিক রাজমুকুট অথচ মনের অন্তঃপুরে আজো পুরাণ, প্রতীকী শক্তি ও আধ্যাত্মবাদ বেঁচে আছে এক অব্যক্ত টানাপড়েনে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই দ্বিচারিতা কেন?

কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতার আত্মা কখনোই নিখাদ যুক্তি বা প্রকৃতিবাদ ছিল না; বরং, এটি এক অস্তিত্ববাদী শূন্যতাকে ঢাকতে চেয়েছে আলোকিত শব্দাবলির আবরণে। তাদের যুক্তি ও প্রকৃতিবাদ ছিল নৈতিক দায় থেকে মুক্তির বাহানা, আর আত্মার কাঁদনকে নিঃশব্দ করে তোলার এক প্রকার মনস্তাত্তি¡ক শাসন।

প্রকৃতি বলতে তারা বোঝে কেবল জৈবিক প্রকৃতি, যেখানে হৃদয়ের কোনো স্থান নেই, বিবেকের কোনো ভিত্তি নেই, নৈতিকতাও নেই। এই প্রকৃতি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের প্রভুত্বে গড়া, যেখানে অনুভূতি, আকাক্সক্ষা আর প্রবৃত্তিই হয়ে ওঠে পথপ্রদর্শক।

মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে অনুভূতি, কামনা (আকাক্সক্ষা) ও প্রয়োজন। ভিত্তি হচ্ছে বস্তুপূজা, প্রবৃত্তির গোলামী, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগত ফলাফল। যুক্তি-প্রমাণ ও সহজ প্রবৃত্তির অনুসন্ধান উপলব্ধি বা যুক্তিপ্রসূত কল্যাণ বলে যাকে তারা অভিহিত করে, তার গভীর তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে জানা যাবে তারা মূলত ‘অভিজ্ঞতাজাত কল্যাণের’ অনুসরণ করে। অর্থাৎ- যে জিনিসের কল্যাণ গাণিতিক নিয়মে বা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপা না যাবে, তাকে তারা স্বীকার করতেই প্রস্তুত নয়। অর্থাৎ উপকারিতা সপ্রমাণ করা না গেলে তার প্রতি ঈমান ও আনুগত্য করা অযৌক্তিক!

পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ মানবতার যে রূপরেখা আঁকছে, তা নীতিহীন, অনুভূতিশূন্য এবং আত্মশূন্য। যেখানে ‘স্বাধীনতা’ মানে শৃঙ্খলের মুক্তি নয়; বরং শৃঙ্খলার ধ্বংস; ‘ভোগ’ মানে ভালো থাকার পূর্বশর্ত, আর ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ মানে অবদমন। তারা আজ এমন এক মুক্তির দর্শন গড়ে তুলেছে, যা মুক্তি নয়; বরং জৈবিক প্রবৃত্তির দাসত্ব।

ইতিহাসের প্রতিচ্ছবিতে যদি আমরা চোখ ফেরাই, তাহলে দেখতে পাবো, পতন একদিন আসে, যখন সভ্যতা নৈতিক ভিত্তি হারায়। রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ব্যাবিলন থেকে বাইজানটাইন, কিংবা জার্মানির নাৎসি বাহিনীর তৃতীয় রাইখ- সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, প্রযুক্তির দম্ভ টিকতে পারেনি আত্মিক শূন্যতার সামনে। হিটলারের প্রগতির যে ‘নির্মমতা’, তা একদিন তার পতনের হাতেই নিজের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছিল।

তাদের সংস্কৃতি আজ যৌনতার নামে অশ্লীলতা, স্বাধীনতার নামে অবাধ্যতা, শিল্পের নামে কুরুচি আর বিজ্ঞানের নামে ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। ওরা বলে : ‘প্রমাণ করো তুমি উপকারী, তাহলেই তোমার অস্তিত্ব যুক্তিযুক্ত!’ অথচ উপকারিতা তো চিরন্তন নয়; বরং স্রোতের মতো পরিবর্তনশীল। যে মূল্যবোধকে দাঁড়িপাল্লায় তোলা যায় না, তাকে তারা সভ্যতার অযোগ্য বলেই ঘোষণা করে। কিন্তু মানুষ কি শুধুই এক বায়োলজিক্যাল ইকুইপমেন্ট? যেখানে আত্মা, হৃদয়, করুণা, ত্যাগ ও বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই?

ফলত, আজকের মুসলিম যুবা, যে এক সময় ছিল সাহস, আত্মত্যাগ ও দার্শনিক ভাবনার প্রতীক, সে-ই আজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির তুচ্ছতম অনুকরণে গর্ববোধ করে। অথচ কুরআন তাকে স্মরণ করায়, ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদেরকে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিয়েছেন।’ (সূরা হাশর-১৯) ইমাম গাজ্জালি বলেছিলেন, ‘যে জ্ঞান আত্মা নির্মাণে সাহায্য করে না, সে জ্ঞান মানবতার জন্য অভিশাপ।’ আর ইবনে তাইমিয়া বলেছিলেন, ‘আল্লাহর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সভ্যতা নয়; বরং ধ্বংসই নিশ্চিত।’ পাশ্চাত্য দার্শনিক নিটশে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বর মরে গেছে’ (মানে পাশ্চাত্যের ধর্মীয় ভিত্তি ভেঙে পড়েছে), আর হেগেল বলেছিলেন, ‘ইতিহাস মূলত বিজয়ীর দর্শন’। অথচ এ বিজয় কিসের? চেতনাশূন্য, আত্মবিবর্জিত, মেকি এক উন্নতির। আজকের পৃথিবী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যে মেরুকরণের মধ্যে পড়েছে, তা পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত সভ্যতারই ফল। একটি শ্রেণী দুনিয়ার ৯০ শতাংশ সম্পদ নিয়ে বসে, বাকিরা যুদ্ধ, অনাহার ও অভিশাপে কাতর। সভ্যতা যদি এই হয়, তবে বর্বরতা কাকে বলে? সভ্যতার উৎস তো ইউরোপের মধ্যযুগীয় অন্ধকার নয়। সভ্যতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল ইসলাম, যেখানে ছিল জ্ঞানের মুক্তি, আত্মার স্বাধীনতা, হৃদয়ের প্রশান্তি। কর্ডোভা, বাগদাদ, দামেস্ক- এই শহরগুলো ছিল সভ্যতার দীপ্ত বাতিঘর। আল খাওয়ারিজমি, ইবনে সিনা, ফারাবি, ইবনে রুশদরা শুধুই দার্শনিক ছিলেন না, তারা ছিলেন সভ্যতার প্রকৃত রূপকার।

আজ যদি ব্যক্তি, জাতি ও বিশ্ব কল্যাণ চায়, তবে ফিরে যেতে হবে সেই সভ্যতায়, যেখানে কামনা নয়, ছিল কোরবানি; যেখানে প্রবৃত্তি নয়, ছিল আত্মসংযম; যেখানে ছিল আল্লাহভীতির নির্মল শুদ্ধতা।

সেই পথই আমাদের মুক্তির পথ। আর সেই সভ্যতাই মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ সভ্যতা, যা সৃষ্টি করে মানুষ, রক্ষা করে নৈতিকতা এবং প্রতিষ্ঠা করে চিরন্তন কল্যাণ।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক