নিরাপত্তা শঙ্কা দেখিয়ে বন্ধের এক দিনের মধ্যে ভারতীয় ভিসা সেন্টারের নিয়মিত কার্যক্রম ফের শুরু হয়েছে। সম্পর্কের এ টানাপড়েন শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে। দু’দিনের ব্যবধানে দু’দেশের হাইকমিশনারকে পাল্টাপাল্টি তলবের ঘটনা উত্তেজনার পারদ বাড়িয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ভারতের নসিহত-প্রেসক্রিপশনের কোনো দরকার নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের উপদেশকে তিনি ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। ঘোরপ্যাঁচে না গিয়ে তিনি সোজা কথায় বলেছেন, ‘তারা (ভারত) জানে এর আগে গত ১৫ বছর যে সরকার ছিল, তাদের সাথে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে সময় তারা (ভারত) একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে আমরা একটি ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে তো আমাদের নসিহত করার কোনো প্রয়োজন নেই।’ ঢাকার অব্যাহত অনুরোধের পরও ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারত যদি তাকে (শেখ হাসিনা) থামাতে না চায়, আমরা থামাতে পারব না। এটি আমাদের মেনে নিতে হবে। আমরা চাইব যে, ভারত তাকে থামাক।’
ভারত কোনোকালে ১৬ ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের বিজয় দিবস ভাবে না। ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে দেখিয়ে আসছে। ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপি বা কংগ্রেস- এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
ঢাকায় এক সমাবেশে ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যকে ‘ভারত থেকে আলাদা’ করার বিষয়ে বলেছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। যদিও তিনি কোন প্রেক্ষাপটে কথাটি বলেছেন তা মিডিয়া থেকে উধাও। হাসনাতের বক্তব্যে প্রতিক্রিয়ায় আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, বাংলাদেশের নেতারা ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি অব্যাহত রাখলে নয়াদিল্লি চুপ থাকবে না। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সেনাকর্মকর্তা অজয় কে রায়নার দাবি করেন, ওসমান হাদির পর পরবর্তী ‘টার্গেট’ হতে যাচ্ছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। বিতর্ক আরো গভীর হয়, যখন ওই পোস্টে তিনি কোথায় গুলি করা দরকার তাও উল্লেখ করে বলেন, ‘গুলি করতে হবে ঘাড়ে, মাথায় নয়। প্রথমে তাকে নিশ্চুপ করাতে হবে এবং ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলোও শুধরে নেয়া হবে।’ এ বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
ভারতের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সন্ত্রাস উসকে দিচ্ছেন। এসব বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানাতে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করা হয়। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা ভারতে বসে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন বানচালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর ষড়যন্ত্র করছেন বলেও প্রণয় ভার্মাকে বার্তা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তলবের সময় ভারতের হাইকমিশনারকে এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। অথচ পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করল। যদিও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী’ যেভাবে ভারতীয় দূতাবাসকে ঘিরে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে সেটিই রাষ্ট্রদূতকে তলব করার প্রধান উদ্দেশ্য। তলবের পরদিন রিয়াজ হামিদুল্লাহ একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টে লিখেন, ‘পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, প্রগতিশীলতা, সুফল ভাগাভাগি আর অভিন্ন মূল্যবোধের ভিত্তিতে দু’দেশের মানুষের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।’
ভারতে জুলাই বিপ্লবীদের ‘জঙ্গি’ আখ্যা দেয়াসহ নানা ঘটনায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে নাখোশ। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় অবস্থান নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। যথারীতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লির কোনো নসিহত শুনতে রাজি নয় ঢাকা। সরকার তার পথে এগোচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন।
এ উত্তেজনাকর সময়ে এবারের বিজয় দিবসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম প্রায় ১৫ বছর আগে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী খাতুনের স্মরণে ‘ফেলানী এভিনিউ’ নামকরণ করেছে। এর আগে ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি চালানো বন্দুকধারীদের ভারতে আশ্রয় নেয়ার আলোচনা আছে। সেখানে হাসনাত আবদুল্লাহ ভারত যদি বাংলাদেশের শত্রুদের তাদের ভূ-খণ্ডে আশ্রয় দেয় তাহলে বাংলাদেশও ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’কে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কথা বলেছেন ।
এর আগে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘কথা বলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছিলেন। জবাবে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিংয়ের ওই মন্তব্যকে ‘অযথার্থ’ এবং ‘শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক সৌজন্যের প্রতি সম্মানজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেছিল। চলতি বছরের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য বা ‘সেভেন সিস্টার্সকে’ ল্যান্ডলকড উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাদের সমুদ্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশই একমাত্র অভিভাবক। তখনো এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন হেমন্ত শর্মা। তিনি বলেছিলেন, ‘যারা নিয়মিতভাবে ভারতের ‘চিকেনস নেক’ নিয়ে হুমকি দেয়, তাদের মনে রাখা উচিত- বাংলাদেশেরও দু’টি এমন সঙ্কীর্ণ করিডোর রয়েছে, যা ভারতেরটির তুলনায় ‘অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’।
এক্সে দেয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশের দু’টি নিজস্ব ‘চিকেনস নেক’ রয়েছে এবং দু’টিই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অপেক্ষা এখন সামনের দিনগুলোর। বাংলাদেশে নির্বাচিত নতুন সরকার এলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নতুন বাঁক নেবে বলে মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ রয়েছে। তা দু’দেশেই। বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে বলে বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেছিলেন দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদি। তার মানে ভারত এখানে নির্বাচনের আবশ্যকতা দেখছে? এ ক্ষেত্রেও বরং বিপত্তি ব্যাপক। নইলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ভারত ভেজাল পাকাচ্ছে কেন? আর ভারত কোনোকালেই এখানে পিপল টু পিপল সম্পর্ক পাতেনি। তাদের যাবতীয় সম্পর্ক গড়ায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে। আর ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনার সাথে। এটি তাদের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক। প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তিনি বলে গেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি আজীবন মনে রাখতে হবে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের রায় জটিল কূটনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার। এ অঞ্চলে ভারতের রফতানি বাণিজ্যের কেন্দ্রও দেশটি। অপরদিকে, বাংলাদেশও ভারতের কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিট রুটের ওপর নির্ভরশীল। গত এক দশকে ভারত ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের নমনীয় ঋণ দিয়েছে। কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ রেলপথ স্থাপন হয়েছে। ভারতীয় গ্রিড ও বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। নিষ্ঠুর আরেক বাস্তবতা হচ্ছে- ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের জনমতের ব্যাপক অবনতিও দৃশ্যমান।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



