দেশ ভাবনা ও নিউ ইয়র্ক ঘটনা

সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, নিউ ইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলাকারী একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম সরব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর জের বেশ কিছু দিন ধরেই চলতে থাকবে। ফলাফল যাই হোক না কেন, এতে দেশের ভাবমর্যাদা কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে- এ প্রশ্ন বিনীতভাবে আয়োজকদের করাই যায়। ১৮ কোটি মানুষের অংশগ্রহণ, হাজারেরও বেশি তাজা প্রাণের শহীদ হওয়া, প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-জনতার পঙ্গুত্ববরণের পেছনে যে আকাক্সক্ষা কাজ করেছে অর্থাৎ- দেশে একটি পরিচ্ছন্ন জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা, তার কোনো তোয়াক্কাই যেন আয়োজকরা করেছেন বলে মনে হচ্ছে না। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চাইছেন, দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে নেতা বড়। নেতার তুষ্টিতেই তাদের মোক্ষ লাভ।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজস্ব ক্ষোভ, দুঃখ ও জীবনযন্ত্রণা প্রকাশের অধিকার সবারই আছে। আছে প্রতিবাদ করার অধিকার; কিন্তু এর অর্থ এই নয়, দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে বিদেশের মাটিতে সরকারপ্রধান ও তার সঙ্গীদের হেনস্তা করা হবে। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটি দেশপ্রেমের প্রকাশ নয়। এটি ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, যা বিদেশীদের মনে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশীদের দলীয় ও ব্যক্তিগত বিবাদের জেরে অনেক দেশে ইতোমধ্যেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভিসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিউ ইয়র্কের ঘটনা এ ব্যাপারে আরো গতি সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে।

পছন্দ হোক বা না হোক, প্রধান উপদেষ্টা কোনো ব্যক্তি হিসেবে নয়, দেশের প্রধান আধিকারিক হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গেছেন। তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা সেখানে বাংলাদেশের নামেই পরিচিত হবেন। তাদের অসম্মান, তাদের অপমান গোটা জাতিকেই অপমান। দেশের ১৮ কোটি সাধারণ নাগরিকের চিন্তা ও চেতনার অপমান। অবশ্য এ ধরনের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখনই লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক গেছেন বিরোধীরা তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। তাতেও কিন্তু দেশের মর্যাদা বাড়েনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে তৈরি হয়নি ভালো ধারণা। এর আগে যারা এসব করেছেন তারা যেমন দেশপ্রেমের অপব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি এখন যারা এটি করছেন তারাও দেশপ্রেমের অবমূল্যায়ন করছেন। দেশপ্রেমের অন্তর্নিহিত ধারণাকে কালিমালিপ্ত করছেন।

দেশপ্রেম দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ করে। দেশের কল্যাণ কামনা, দেশের উন্নয়ন, দেশের জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, দেশের মর্যাদা সংরক্ষণ (দেশে ও বিদেশে), ইত্যাদির সামষ্টিক প্রকাশ দেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষকে দেশের জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মযোগী করে। প্রেরণা তৈরি করে সামষ্টিকভাবে সবাইকে নিয়ে বেকার সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে। দেশপ্রেম মানুষ হত্যা করতে শেখায় না, শেখায় না সাধারণ জনগণকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় গড়তে। প্রতিটি ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করে দেশপ্রেম। মানুষের মর্যাদা ও কর্মসংস্থানের অধিকারের প্রতি সম্মান করতে শেখায়। বিভাজিত সমাজ ও জাতি কখনোই দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়। দেশপ্রেম শেখায়- যেকোনো স্থানে যেকোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আইনের প্রতি আস্থাশীল থাকতে। নিউ ইয়র্কে যা ঘটেছে তা কোনো অবস্থাতেই দেশপ্রেমের আওতায় পড়ে না। উল্টো লুটেরাদের সহযোগী ও জুলাই বিপ্লবকে অপমানিত করার মনোভাবই প্রকাশ করে। শহীদ জুলাইযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করে। এ যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের রক্তঋণ প্রথায় প্রত্যাবর্তন। যেহেতু তোমরা আগে এটি করেছ, আমরাও তার প্রত্যুত্তর দেবো একইভাবে। এ যেন এক সীমাহীন যাত্রা। তারা ভুলে যাচ্ছেন এর আগে যারা এটি করেছেন তারা এক ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে, লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রকাশ হিসেবে করেছেন। এখন যারা এটি করছেন তারা ফ্যাসিস্ট ও লুটেরাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে করেছেন। এদের কাছে দেশ বড় নয়, বড় নয় দেশের মানুষের মর্যাদা ও চেতনা। এরা ভুলে যাচ্ছেন, জুলাইযোদ্ধা এবং গোটা জাতির একটিই প্রত্যাশা- তা হলো দেশে একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা; যেখানে সমুন্নত থাকবে মানুষের অধিকার, মর্যাদা, সুবিচার, দায়বোধ ও দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহি। বিদেশের মাটিতে বসে জাতীয় নেতাদেরকে অপমান করার মাধ্যমে তা অর্জিত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন জাতীয় ঐক্য ও কর্মযোগ।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]