একটি এপিটাফের জন্ম

বুড়িগঙ্গা আজ দখলদারদের কাছে পরাজিত, পর্যুদস্ত। বুড়িগঙ্গা হার মেনেছে রাজনীতির পরাশক্তি, পেশিশক্তির কাছে। অথচ বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী সংস্কার করে পর্যটন শিল্পে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি নদী হয়েছে আয়ের ও বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র। ‘

নয়া দিগন্ত

আজ থেকে ৫০ বছর আগে ঢাকা ছিল বাসযোগ্য সবুজে ঘেরা এক নগরী। প্রকৃতিপ্রেমীরা ছয় ঋতুর আবর্তনচক্র সহজেই বুঝতে পারতেন। ফাল্গুনের বাসন্তী আবহ, রঙবেরঙের ফুলের সমারোহ দেখে সবাই বুঝতেন বসন্ত এসে গেছে। বৃষ্টির অঝোর ধারা আর ভেজা কদম ফুলের গন্ধ স্মরণ করিয়ে দিত বর্ষার আগমনী। নানা রকম রসালো দেশীয় ফলের সমারোহ ছিল তার অলঙ্কার। বর্তমানের ঢাকায় সারা বছরই খরা। বর্ষবরণ, বসন্ত উৎসব, নবান্ন- এসব এখন শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের চার দেয়ালের ফ্রেমে বন্দী। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বুড়িগঙ্গার ছলাৎ ছল পানির আওয়াজ হারিয়ে গেছে।

বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ‘ঢাকাই’ সভ্যতা এখন জঞ্জালের জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কয়েক বছর আগেও ছিল সবুজের সমারোহে উজ্জ্বল। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহে পাখ-পাখালির কলকাকলিতে ছিল সরব। পাখি দেখার জন্য ও নাম না জানা ফুলের আকর্ষণে অনেকেই আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজের সমারোহে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, রমনা উদ্যান, বলধা গার্ডেন- সবই ছিল ঢাকার ফুসফুস। বুড়িগঙ্গার তীরে সকাল-সন্ধ্যা হাঁটার প্রচলন এখন আর নেই। আবর্জনার স্তূপে, অসহ্য দুগর্ন্ধের নাম এখন বুড়িগঙ্গার তীর। বাহাদুর শাহ পার্ক, ওয়াইজ ঘাট কর্মব্যস্ত মানুষের পদভারে অপরিচিত গন্তব্যের নাম। ধোলাই খাল এখন শুধুই ইতিহাস।

ক’দিন আগে ঢাকা চাঁদপুর নৌভ্রমণে গিয়েছিলাম চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ সমিতির আমন্ত্রণে। ভ্রমণে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে বিস্মিত, হতভম্ব, ব্যথিত হয়েছি। শিউরে উঠেছি ভবিষ্যতের কথা ভেবে। পারাবত ১৮ নামের বিশাল নৌযান, চমৎকার ব্যবস্থাপনা। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল। ঢাকা নৌবন্দরে সারি সারি নৌযান বাঁধা। বাহারি নামের নৌযানগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। সদরঘাটের কোলাহল, ব্যস্ততা, হকারদের চিৎকার কোনো কিছুই নেই। যাত্রীর অভাবে এসব নৌযান এখন অলস দিন কাটায়। শুনলাম, কিছু নৌযানকে এখন হোটেলে রূপান্তর করা হয়েছে। ঢাকায় আসা লোকজন, হকার, মুটে-মজুরদের রাত্রিকালীন আবাস এখন এই নৌযানগুলো। সদরঘাটে ঢুকলেই অসহ্য দুর্গন্ধে যে কাউকে, বিশেষ করে নবাগতদের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চাইবে। সদরঘাট ঢাকা শহরের প্রবেশ এবং বহির্গমন পথ। এর এই দুরবস্থা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগা-স্বাভাবিক, এত বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখাশোনা করার কেউ আছে কি না! সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা বুড়িয়ে গেছে। উত্তাল খরস্রোতা বুড়িগঙ্গা এখন বয়সের ভারে জঞ্জালের জঙ্গল আর শীর্ণকায়া মৃতপ্রায়।

বুড়িগঙ্গার পানি এখন রূপান্তরিত হয়ে ¯øাজ (ঝখটউএঊ) বা কাদাজলে পরিণত। বুড়িঙ্গার এখন স্র্রোতহীন নদী, মৃতনদী। নদীর ওপারে নদীর তীর ঘেঁষে, অনেক ক্ষেত্রে নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে স্থাপনা। যেন মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচি কাটছে নদী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত মহানদের (!) প্রতি। সদরঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিশেষ করে নদীর ডানতীরে নদীর সীমানা পিলারের ভেতর অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে। কোথাও ভাটার সীমানা নদীর পানির মাত্র কয়েক হাত দূরে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় বড় বড় খননযন্ত্র দিয়ে খননের কাজ সমানে চলছে। ছোট ছোট বার্জ ভর্তি করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য। নদীর তীরে পানির ভেতর এভাবে নদীর তলদেশ থেকে মাটি ও বালু ওঠালে পরিণতি কী হবে তা ভাবার কেউ নেই। এভাবে বুড়িগঙ্গা বুড়িয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। স্রোতহীন, কর্দমাক্ত বিবর্ণ বিষাক্ত পানি এবং দুর্গন্ধে তেষ্টানো দায়। এই পরিবেশে বাস করছেন, এই পানিতে দৈনন্দিন কাজকর্ম সারছেন লাখ লাখ মানুষ। বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন কোনো মাছ নেই। কোনো কোনো জায়গায় কচুরিপানা অবাধে বংশবিস্তার করছে। অবাধে নদী দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনার জন্য কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে শোনা যায়নি। মাঝে মধ্যে কুম্ভকর্ণের মতো হঠাৎই কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে। দু’-এক দিন হম্বিতম্বি দেখিয়ে কিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়ার ফটোসেশন, পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবর হওয়া পর্যন্তই নদী উদ্ধার। এমনকি উদ্ধারকৃত জায়গার নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। ফলে দখলদাররা নতুন উদ্যমে নামে আরো সম্প্রসারিত দখলদারিত্বের জন্য। এভাবেই বুড়িগঙ্গাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়। বেশ কয়েকবার শোনা গিয়েছিল ঢাকার চতুর্দিকে চক্রাকার নৌপথের কথা। গাবতলীর কাছেই দেখা যাবে চক্রাকার নৌপথের পন্টুন কাত হয়ে পড়ে আছে। দুই পাশে বালির পাহাড়। এভাবে চললে আগামী ২০-২৫ বছরের ভেতর এ নদীপথটি বিলীন হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

মাত্র ২৫ বছর আগে বুড়িগঙ্গার তীরে সকালে বসত মাছের বাজার। নদীর তাজা এবং জীবন্ত বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। আমি নিজে বহুবার গেছি মাছ কেনার জন্য। তখন বুড়িগঙ্গার পানি বেড়িবাঁধের বুকে আছড়ে পড়ত। বেড়িবাঁধের পাড়ে বসত মাছের বাজার। দখল হতে হতে বুড়িগঙ্গা এখন শহর। নিয়ন আলোর চোখ ধাঁধানো সড়ক বাতিতে আঁধার এখানে লজ্জায় মুখ লুকোয়।

১৯৯৮-এর বন্যায় যেসব এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ত্রাণ বিলিয়েছি সেগুলো এখন ব্যস্ত জনপদ। বুড়িগঙ্গা আজ দখলদারদের কাছে পরাজিত, পর্যুদস্ত। বুড়িগঙ্গা হার মেনেছে রাজনীতির পরাশক্তি, পেশিশক্তির কাছে। অথচ বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী সংস্কার করে পর্যটন শিল্পে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি নদী হয়েছে আয়ের ও বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র। ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ আন্দোলন আঁতুরঘরে মারা গেছে। এখন বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর কথা বলারও কেউ নেই। বরং বুড়িগঙ্গা দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। ‘এখানে একদিন একটি উত্তাল তরঙ্গময়ী নদী ছিল’ বুড়িগঙ্গায় জায়গায় হয়তো অচিরেই এরকম একটি এপিটাফ লেখা হবে। যেমন- এপিটাফের স্মৃতি হয়ে ইতিহাসের বুকে আশ্রয় নিয়েছে ধোলাইখাল ও বার্লিন প্রাচীর। বুড়িগঙ্গার বুক চিরে চলা রঙবেরঙের পালতোলা নৌকা, বাণিজ্যিক নৌকা, যাত্রীবাহী বড় বড় নৌযানের ভেঁপুর আওয়াজ এখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। পানসি নৌকার নাম হারিয়ে যাওয়ার পথে। বুড়িগঙ্গার সেই রঙিন দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। এভাবেই হত্যা করা হয়েছে তুরাগ নদীকে। হত্যার তালিকায় যোগ হয়েছে শীতলক্ষ্যাও। হয়তো সেখানেও একদিন তৈরি হবে নতুন এপিটাফ- ‘এখানে একটি নদী ছিল’।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ