সন্তুষ্টচিত্তে প্রতিপালকের প্রতি প্রত্যাবর্তন

আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ ছিলেন এক অনন্য সাধারণ গুণাবলির অধিকারী, মেধাবী, আদর্শ চরিত্রবান, প্রশস্ত-হৃদয়, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বসচেতন ও প্রচারবিমুখ, ইসলামী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এক নেতা

‘হে প্রশান্ত আত্মা তুমি সন্তুষ্টচিত্তে তোমার প্রতিপালকের প্রতি প্রত্যাবর্তন করো এবং অন্তর্ভুক্ত হও আমার বন্দাদের মধ্যে, আর প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।’ (আল কুরআন)

পবিত্র কুরআনের এ ঘোষণার দিকে মনোনিবেশ করলে মনে হয় আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ এ কাতারের একজন। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল্লামা ইকবালের একটি কবিতার নিম্নোক্ত পঙক্তিটি পাঠ করলে মনে হবে যেন তাতে উপর্যুক্ত আয়াতের প্রতিধ্বনি করছেন তিনি। বলেন : মুমিনের চিহ্ন কী বলব তোমায়/ঠোঁটে তার হাসি ছড়ায় মৃত্যু যখন এসে যায়।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বিগত দীর্ঘ ৪০ বছর আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তাকে দেখেছি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, আর তিনি ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। তাকে আমি দেখেছি এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলাম, আর তিনি ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তাকে দেখেছি ইসলামী আন্দোলনের মহাসড়কের বুকে মহৎ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান শোভাযাত্রার একজন সহযাত্রীরূপে।

আমি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ ছিলেন এক অনন্য সাধারণ গুণাবলির অধিকারী, মেধাবী, আদর্শ চরিত্রবান, প্রশস্ত-হৃদয়, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বসচেতন ও প্রচারবিমুখ, ইসলামী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এক নেতা। কোনো দিন তার চেহারায় রাগের কিংবা বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কোনো চিহ্ন দেখতে পাইনি। সবসময় নীরবে এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কোনো দিন তোয়াক্কা করতেন না অন্যরা তার অবদানের স্বীকৃতি দিলো কি না সে বিষয়ে। একবার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট তাকে ওই পদ থেকে ছাত্রবিষয়ক পরিচালক পদে বদলি করে। তখন কোনোরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ছাড়া বদলিকৃত পদে দায়িত্ব গ্রহণ করে অত্যন্ত যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাহ্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদ থেকে ছাত্রবিষয়ক পরিচালক পদে বদলি পদাবনতির নামান্তর। কিন্তু আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ এটিকে কোনো সমস্যা মনে করেননি। এর প্রধান কারণ হিসেবে যতটুকু মনে করি, তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, আসলে একটি প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ছাত্রবিষয়ক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ দায়িত্বে থেকে শিক্ষার্থীদের নৈতিক উন্নয়ন এবং আদর্শিক দিকনির্দেশনাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে। আসলে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রধান চরিত্র, যা এ প্রতিষ্ঠানকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে তা হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিভুক্ত কোর্সগুলোর পাঠদানের পাশাপাশি তাদের নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। এ কর্মসূচি দেখাশোনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ছাত্রবিষয়ক বিভাগ।

এ বিভাগে এমন তিনজন নিষ্ঠাবান দায়িত্বশীলের সমাবেশ ঘটেছে যারা একটি আদর্শ ও উন্নত চরিত্রবিশিষ্ট প্রজন্ম তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণদানে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। এ তিনজনের বরিষ্ঠ ছিলেন ডক্টর আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ। বিগত ২০ বছরে ছাত্রবিষয়ক বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত এ ত্রিরত্নের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ পেয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতিকে উপহার দেয়া হয়েছে ২০ সহস্রাধিক আদর্শবান গ্র্যাজুয়েট, যারা একদিকে যেমন নিজস্ব বিষয়ে উন্নত জ্ঞানের অধিকারী তদ্রুপ চিন্তা-চেতনা আচার-আচরণ ও চারিত্রিক গুণাবলিরও অধিকারী। এর জন্য সর্বোচ্চ ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য মরহুম আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ।

মরহুম আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ ছিলেন বহু গুণের অধিকারী এক অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সুরকার, সমাজচিন্তক, প্রাবন্ধিক, শিশুসংগঠক, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান কর্ণধার, গবেষক, সুবক্তা এবং একজন নির্যাতিত- জননেতা ও নিষ্ঠাবান কর্মী।

আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন মরহুম ওবায়েদুল্লাহর সব সৎকর্ম বহুগুণ বাড়িয়ে তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তার সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেন। আমিন।

লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, আইআইইউসি