জাকসু নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা

এখনো উন্মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ লক্ষণীয়, তথাপিও নির্বাচন ভণ্ডুল করার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন, যাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আছে, তারা কিছুতেই পরাজয় মেনে নেবে না। তারা নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া বা বানচাল করার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। তিন দশক পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ছাত্র সংগঠন, প্রার্থী ও সমর্থকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ক্যাম্পাসের সব জায়গায় আলোচনার মূল বিষয় এখন জাকসু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সৎ, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত মোট আটবার জাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এত বছর নির্বাচিত ছাত্র সংসদ না থাকায় তাদের অধিকার আদায়ের কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে দলীয় স্বার্থে কাজ করেছে। জাকসুর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করবেন বলে সবার আশা।

ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। সব পক্ষ তাদের প্যানেল নিয়ে তৎপরতাও শুরু করেছে। ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেল ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির জাবি শাখা।

শিবিরের প্যানেলে ২৫ প্রার্থীর মধ্যে ছয়জন ছাত্রী। সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট থেকে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে শাখা শিবিরের সদস্য ও ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র আরিফুল্লাহ আদিব, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে শাখা শিবিরের অফিস ও প্রচার সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম।

ইসলামী ছাত্রশিবিরও দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে সক্রিয়। কয়েক মাস ধরে তারা মেডিক্যাল ক্যাম্পসহ সামাজিক কর্মসূচি চালিয়েছে। প্যানেল ঘোষণা শেষে ভিপি পদপ্রার্থী আরিফুল্লাহ আদিব বলেন, ‘আমরা দলীয় ব্যক্তিদের বাইরেও প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে শিক্ষার্থীরা প্যানেলটি নিজের মনে করে। আমরা বিজয়ী হলে চব্বিশের স্পিরিট ধারণ করে দলমত নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে কাজ করতে চাই।’ এ দিকে নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ ২৩ সদস্যের প্যানেল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-জাবি শাখা। প্যানেল ঘোষণার পর সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘আমাদের প্যানেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যকে স্থান দেয়া হয়নি। যারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণে ও সা¤প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থেকে ভূমিকা রেখেছেন, আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এ ছাড়া বিএনপি-সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও কিছু বাম সংগঠনও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। জাকসু নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২৫টি পদের বিপরীতে ২৭৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

এবারের জাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। ডাকসু, জাকসু ও রাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে ও আগামীর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে সবার বিশ্বাস। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ নিয়ে আসতে পারে। অতীতে বিশেষত ১৬ বছরে ছাত্রলীগ যে ফ্যাসিবাদের নিকৃষ্ট নমুনা শিক্ষাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এবারে কোনোভাবেই চাচ্ছেন না সেই ধারা, সেই অত্যাচার ও অনাচার ফিরে আসুক।

বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ক্ষমতাশ্রয়ী। সুতরাং ক্ষমতার বাহন হিসেবে তারা ছাত্র রাজনীতি বহাল রাখতে চাইবে- এটিই স্বাভাবিক। তবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়; বরং লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির অবসান হোক, এটি সব অভিভাবক ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যাশা। তাই ক্যাম্পাসগুলোতে এবার সরাসরি কোনো ছাত্র সংগঠনের নামে প্যানেল কেউ ঘোষণা করছে না। এককভাবে লড়ার চেয়ে তারাও অনেকেই গণ-অভ্যুত্থানপন্থী যেকোনো সংগঠনকে সাথে নিয়ে এগোতে চায়। ডাকসু ও জাকসুতে এমনই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সব সংগঠন ডান অথবা বাম- সবারই কমন কৌশল হচ্ছে ‘সম্মিলিত প্যানেল’। শক্তিশালী ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্যানেল গঠনই প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগের মতো ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রীর পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখগুলো প্যানেলে টানতে নানাভাবে চেষ্টা করছেন ছাত্রনেতারা। ইসলামী ছাত্রশিবিরও এককভাবে লড়ার চেয়ে গণ-অভ্যুত্থানপন্থী যেকোনো সংগঠনকে সাথে নিয়ে এগোতে চায়।

এখনো উন্মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ লক্ষণীয়, তথাপিও নির্বাচন ভণ্ডুল করার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন, যাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আছে, তারা কিছুতেই পরাজয় মেনে নেবে না। তারা নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া বা বানচাল করার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

এমতাবস্থায় জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনা মোতায়েন চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাবেষ্টনী জোরদার করতে আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনের দিন, এর আগের দিন এবং নির্বাচনের পরের দিন সেনা মোতায়েনের জন্য ইতোমধ্যে সেনাপ্রধানের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও কাজ করবেন। তবে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে ক্যাম্পাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। তবে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সবাই অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়।

লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাবি