২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ১৩ বছর পার হয়ে গেছে। এই দিনে কী ঘটেছিল শুধু তা-ই নয়; বরং কিভাবে ঘটেছিল তা-ও পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি। কারণ তার দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়াটি আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয়।
২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও আর কোনো সুযোগ ছিল না। প্রায় তিন মাস পর, ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে রায়ের লিখিত কপি স্বাক্ষরিত হয় এবং ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর রায়টির একটি অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠানো হয়। সে দিন ট্রাইব্যুনাল সময়ের আগে বিচারিক কাজ শেষ করে মৃত্যু-পরোয়ানা প্রস্তুতের কাজে হাত দেন। পরোয়ানাটি চূড়ান্ত হওয়ার পর একটি লাল খামে ভরে তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই সেটি জনাব মোল্লাকে পড়ে শোনানো হয়।
জেল কোড (কারাবিধি) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে আব্দুল কাদের মোল্লার হাতে সাত দিন সময় ছিল; কিন্তু তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের জনসমক্ষে দেয়া বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, সরকারের জেল কোড অনুসরণের কোনো অভিপ্রায় ছিল না। কেন জেল কোডকে উপেক্ষা করা হবে, তার কোনো স্পষ্ট আইনি কারণও দর্শানো হচ্ছিল না। অথচ সরকার এ পর্যন্ত জেল কোড মেনে আসছিল- জনাব মোল্লাকে কারাগারে ‘ডিভিশন-১’ পদমর্যাদা দেয়া হয়েছিল এবং কারাবিধি অনুযায়ী তাকে প্রয়োজনীয় পোশাক ও অন্যান্য সরঞ্জামও সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যায়ে, যখন সরকার দ্রুত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চাইল, তখন সেই জেল কোড তাদের জন্য বড় এক বাধা হয়ে দাঁড়াল।
৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আমার বাবা, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, গুলশান আজাদ মসজিদে সালমান এফ রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সালমান এফ রহমান তাকে জানান, সে দিনই আইন প্রতিমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র সচিবকে স্পষ্ট করে বলেছেন, জেল কোড মানার কোনো প্রয়োজন নেই। আইন মন্ত্রণালয় যেহেতু এ অবস্থান নিয়েছে, স্বরাষ্ট্র সচিবও তাতে কোনো বাধা দেখেননি। একপর্যায়ে আইন প্রতিমন্ত্রীর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে সেই শিউরে ওঠার মতো প্রশ্ন- ‘আজই কেন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে না? কিন্তু একটি বাধা ছিল। জাতিসঙ্ঘের রাজনৈতিক-বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। সরকার চাইছিল না, জাতিসঙ্ঘের একজন প্রতিনিধি দেশে থাকা অবস্থায় একটি বিতর্কিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হোক। তাই সিদ্ধান্ত হয়, তারানকো দেশ ছাড়ার পরই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এ তথ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিল- এখানে কোনো নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকবে না, আইনের কোনো আনুষ্ঠানিক অনুসরণও করা হবে না। সরকার যত দ্রুত সম্ভব জনাব মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করতে চাইছে। ফলে আমাদেরও আর দেরি করার সুযোগ ছিল না। তাই আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯ ডিসেম্বর সোমবারের মধ্যে একটি ‘রিভিউ’ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন প্রস্তুত করা হলো। রিভিউ আবেদন আর আপিল এক জিনিস নয়। রিভিউ আবেদন করা হয় আপিল বিভাগের সেই একই বিচারকমণ্ডলীর কাছে, যারা মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন। রায়ে কেবল খুব স্পষ্ট ও দৃশ্যমান কোনো ভুল থাকলে তবে রিভিউয়ের মাধ্যমে তা সংশোধন করা হয়। তা ছাড়া একই বিচারকমণ্ডলীকে এটি বোঝানো সবসময় কঠিন যে, তারা আগে ভুল করেছিলেন। এ কারণে বলা হয়, হাজারটি রিভিউ আবেদনের মধ্যে বড়জোর একটি মঞ্জুর হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রিভিউ আবেদনটি এখনই জমা দেবো না; বরং যখন দেখা যাবে ফাঁসি কার্যকর করা একদম সুনিশ্চিত, ঠিক তখনই এটি দাখিল করা হবে। আমরা জানতাম আমাদের আবেদনটি শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যাবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার এই বেআইনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়াটিকে কিছুটা বিলম্বিত করা। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ১২ ডিসেম্বর আবেদনটি জমা দেয়ার দিন ধার্য করি। জেল কোড অনুসারে, প্রাণভিক্ষার আবেদন করার জন্য যে সাত দিন সময় পাওয়া যায়, তা গণনা করার কথা ৮ ডিসেম্বর থেকে, যে দিন মোল্লাকে পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছিল। কিন্তু একটি ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা কাজ করছিল যে, সরকার হয়তো ৫ ডিসেম্বর (যে দিন রায়ে স্বাক্ষর করা হয়েছিল) থেকে এ সময় গণনা শুরু করতে পারে। মাত্র এক দিনের ভুলের মাশুল দেয়ার ঝুঁকিও আমরা নিতে পারছিলাম না। তাই আমরা আগের তারিখটিকে গণনায় ধরলাম এবং ১২ ডিসেম্বরকে রিভিউ আবেদন জমা দেয়ার চূড়ান্ত দিন হিসেবে ঠিক করলাম।
একই সাথে আমরা খুব সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। যদি নির্ধারিত সময়ের আগে ফাঁসি কার্যকর করার কোনো সামান্য ইঙ্গিতও পাওয়া যেত, তবে আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত ছিলাম। সেই ইঙ্গিতটি এলো ১০ ডিসেম্বর। আমরা যখন পল্টন টাওয়ারে ডিফেন্স অফিসে কাজ করছিলাম, তখন মোল্লার বড় ছেলে হাসান জামিলের কাছে বাসা থেকে একটি ফোন আসে। জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত¡াবধায়ক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি তার মায়ের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। চিঠিতে পরিবারকে ওই দিন রাত ৮টার মধ্যে জনাব মোল্লার সাথে দেখা করতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ- তাদের মাত্র তিন ঘণ্টার নোটিশ দেয়া হয়েছিল। চিঠির ভাষা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, এটিই হতে যাচ্ছে তাদের শেষ সাক্ষাৎ। পাশাপাশি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেও তথ্য পাওয়া গেল, রাত ১২টা এক মিনিটে মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সন্ধ্যার মধ্যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিরতিহীনভাবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ চলতে শুরু করল। আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার, এমনভাবে খবরগুলো প্রচার করা হচ্ছিল। সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৭টায় আইন প্রতিমন্ত্রী টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন, সরকার ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিভিউ আবেদনের জন্য অপেক্ষা করেছিল; কিন্তু যেহেতু কোনো আবেদন জমা পড়েনি, তাই সেই রাতেই দণ্ড কার্যকর করা হবে।
ফলে, আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রিভিউ আবেদনটি জমা দেয়ার প্রস্তুতি নিলাম। রাত ৯টায় আমার বাবা, অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেন ও অ্যাডভোকেট মো: তাজুল ইসলাম জনাব মোল্লার ফাঁসি স্থগিতের জরুরি আদেশের জন্য চেম্বার জজ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাসভবনে গেলেন। আমরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। তারা যখন ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন আমাদের জানানো হলো, ফাঁসি স্থগিতের এই আবেদনের একটি অনুলিপি অ্যাটর্নি জেনারেলকে পৌঁছে দিতে হবে।
পরবর্তী সময়ে আমার বাবা আমাকে এমন একটি কথা বলেছিলেন যা ছিল অত্যন্ত অস্বস্তিকর। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাকে জানিয়েছিলেন, তিনি সারা দিন আমাদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন; কিন্তু আমরা তো তাকে আগে থেকে জানাইনি যে, আমরা আসছি। তিনি কিভাবে জানবেন, আমরা আসব? এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি আগে থেকে জানতেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা রিভিউ আবেদন করতে এবং তার কাছে ফাঁসি স্থগিতের আর্জি জানাতে বাধ্য হবো। তিনি জানতেন, কারণ নির্বাহী বিভাগ থেকে তাকে আগেই জানানো হয়েছিল, পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে আমরা আজ রাতে তার কাছে যেতে বাধ্য হই। বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ মিলে রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের বাসভবনে গেলাম; কিন্তু তিনি ঠিক তার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে সংবাদমাধ্যমে জানানো হচ্ছিল, তিনি প্রধান বিচারপতির সাথে আছেন। আমরা পুনরায় চেম্বার জজের কাছে ফিরে এলাম। রাত আনুমানিক ১০টা ২০ মিনিটের দিকে স্থগিতাদেশটি স্বাক্ষরিত হলো। পরের দিন সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিত করা হলো। আমরা প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে সুপ্রিম কোর্টে ছুটে গেলাম এবং সেখান থেকে দ্রুত পৌঁছালাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে তখন হতাশ সাংবাদিকদের ভিড়; তাদের উপস্থিতিতে স্থগিতাদেশটি নথিভুক্ত করা হলো। সেই রাতে আর ফাঁসি কার্যকর হলো না।
১১ ডিসেম্বর, দেশব্যাপী অবরোধ সত্তে¡ও রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আমার বাবা শুনানিতে সময়ের আবেদন করেন। তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, রায়ের দৈর্ঘ্য ছিল ৭৯০ পৃষ্ঠা এবং এটি ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়েছিল মাত্র ৫ ডিসেম্বর; অর্থাৎ- রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতির জন্য আমরা এক সপ্তাহেরও কম সময় পেয়েছি, অথচ আইনত আমাদের ৩০ দিন সময় পাওয়ার কথা ছিল। তিনি আরো উল্লেখ করেন, আপিল বিভাগ রায়টি লিখতে এবং চূড়ান্ত স্বাক্ষরের জন্য প্রায় তিন মাস (১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর) সময় নিয়েছিল। তাই যে রায় লিখতে বিচারকদের এত দীর্ঘ সময় লেগেছে, সেই সম্পূর্ণ রায়টি পড়া এবং পর্যালোচনার জন্য আইনজীবীদের অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় দেয়া মোটেও অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন সময়ের আবেদন মঞ্জুর করতে অস্বীকার করেন এবং আমাদের যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ কমিয়ে দেয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় রিভিউ আবেদনটি খারিজ করে দেয়া হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ (শর্ট অর্ডার) দেয়ার অনুরোধ জানান, যাতে সেই রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা যায়। বেলা ৩টায় সেই সংক্ষিপ্ত আদেশে স্বাক্ষর করা হয়। ওই দিন রাত ১০টা এক মিনিটে সেই সংক্ষিপ্ত আদেশের ভিত্তিতে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আব্দুল কাদের মোল্লা কোনো দিন আপিল বিভাগের সেই পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে যেতে পারেননি বা পড়তে পারেননি, যা কয়েক মাস পরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এটি ছিল আপিল বিভাগের নৈতিক স্খলনের অন্যতম চরমপর্যায়। আদালত এখানে একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা’ করার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। ন্যায়বিচার যখন তার স্বাধীনতা হারিয়ে শাসনের শিকলে বন্দী হয় এবং শাসকের আজ্ঞাবহ হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তা কতখানি প্রলয়ঙ্করী হতে পারে, এ ঘটনা তার এক জীবন্ত আখ্যান।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



