ট্রাম্পের শুল্কনীতি, রফতানির নতুন সম্ভাবনা

ট্রাম্পের করছাড় নীতি বাংলাদেশের জন্য এক ‘অপরচুনিটি উইন্ডো’ তৈরি করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট গার্মেন্টস রফতানি ৬০ বিলিয়ন ডলার পেরিয়ে যেতে পারে। অন্যথায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর কাছে পিছিয়ে পড়বে।

বাংলাদেশের রফতানির প্রাণ তৈরী পোশাক (RMG) ) খাত। দেশের পণ্য রফতানির ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এ খাত থেকে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই নারী। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে শুল্কনীতির সামান্য পরিবর্তনও বাংলাদেশের উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ঢেউ তোলে। ২০২৫ সালে মার্কিন প্রশাসনের ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির আওতায় বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ এবং তার ধাপে ধাপে সমন্বয় বাংলাদেশের জন্য নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।

প্রি-ট্রাম্প যুগে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকে যুক্তরাষ্ট্রে গড় (MFN (Most-Favored Nation) শুল্কহার ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ ছিল; অনেক ক্যাটাগরিতে ১৫-১৭ শতাংশের কাছাকাছি, কিছু আইটেমে ৩০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিত রয়েছে; ফলে রেডিমেট গার্মেন্টসের মতো প্রধান পণ্যগুলোতে শুল্কছাড় পাওয়া যায়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও, তৈরী পোশাক খাতের বিশ্ববাজারে দোলাচল ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের যা ২০২৩ সালের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৫ সালের রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ নতুন হিসাব কষতে বাধ্য করছে এ শিল্পকে।

২০২৫ সালের এপ্রিলে ঘোষিত নতুন নীতিতে ‘বেস’ বা সর্বজনীন ট্যারিফ এবং দেশভেদে ‘রিসিপ্রোকাল’ অতিরিক্ত শুল্কের সমন্বয় দেখা যায়। এর মধ্যে চীনের ওপর ৩০ শতাংশ, ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়, আর বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম শ্রেণীতে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য হয়। ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকে কার্যকর মোট শুল্কহার দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ শতাংশ। এই গাণিতিক বাস্তবতা মূল্য-চাহিদা-সরবরাহের সমীকরণ পাল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশের কস্ট টু আমেরিকান বায়ার্স তীব্রভাবে বেড়ে গেছে, যা গ্রাহকের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। আবার একই সাথে প্রতিযোগীদের কারো কারো ওপর উচ্চ শুল্ক বাংলাদেশের অবস্থান কিছু ক্যাটাগরিতে তুলনামূলক সুদৃঢ়ও করতে পারে।

অবশ্য, ট্যারিফ পার্থক্যই সবকিছু নয়। ভিয়েতনাম বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বড় সোর্সিং-হাব, যেমন- উৎপাদন দক্ষতা, কমপ্লায়েন্স, দ্রুত লিডটাইম, সরবরাহ শৃঙ্খলা ও বন্দর দক্ষতায় তারা এগিয়ে আছে। ২০১৮-২১ সময়ে চীনের ওপর সেকশন-৩০১ ট্যারিফ বাড়ার পর ভিয়েতনাম সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিতে পেরেছে। ২০২৫ সালের রিসিপ্রোকাল ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম-বাংলাদেশ উভয়ের জন্য সমান হলেও অপারেশনাল দক্ষতায় এগিয়ে থাকায় ভিয়েতনাম এখনো অনেক ব্র্যান্ডের প্রথম পছন্দ। অতএব, ট্যারিফ সমান হলে নন-ট্যারিফ প্রতিযোগিতাগুলোই (লিডটাইম, কোয়ালিটি, কমপ্লায়েন্স, বন্দর, এনার্জি) নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। এ দিকে তুরস্কের ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত হার থাকলেও তাদের ইউরোপমুখী ভৌগোলিক সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রে ততটা প্রযোজ্য নয়; ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ তুলনামূলক কম। চীনের ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ও বিদ্যমান শুল্কসহ খরচ আরো বেড়েছে।

এই জটিল পটভূমিতে বাংলাদেশের সুযোগ হলো ভারত থেকে সরে যাওয়া কিছু অর্ডার টেনে আনা; চীন ও ভিয়েতনামের উচ্চ-মার্জিন কাজের বাইরে ‘ভ্যালু-মিড’ সেগমেন্টে প্রাইস-কোয়ালিটির ভারসাম্য দিয়ে প্রবেশ জোরদার করা। তবে সতর্কতা হলো- বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গঋঘ বেস-হার ভিন্ন, তার ওপর দেশভিত্তিক অতিরিক্ত হার বসে। তাই প্রোডাক্ট-মিক্স বদল করে ‘ইফেক্টিভ ট্যারিফ’ কমানোর কৌশল প্রাসঙ্গিক।

শুল্ক বাড়লে আমদানিকারকের খরচ বাড়ে। তবে, কখনো রিটেইলার নিজে খরচ শোষণ করে, কখনো দাম বাড়িয়ে কনজিউমারের ওপর চাপায়, কখনো সোর্সিং দেশ বদলায়। ইতোমধ্যে অনেক বড় রিটেইলার ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শুল্কের কারণে দাম কিছুটা বাড়ানোর কথা বলেছে; ফলে লো-মিড ভ্যালু সেগমেন্টে ডিমান্ড কিছুটা কমতে পারে। ২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশ-মার্কিন পোশাক রফতানি আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেড়েছিল। এতে প্রমাণিত হয়, নীতি-ঝাঁকুনির মধ্যেও আমেরিকান বায়াররা বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলোর সক্ষমতা যাচাই করে নতুন অর্ডার দিয়েছে। তবে জুলাই-আগস্টে উচ্চ ট্যারিফ বসার পর অর্ডার বুকিংয়ের গতি পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ২০২৪-২৫ সময়ে কিছু কারখানা বন্ধ-খোলা মিলিয়ে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে; ফলে প্রায় এক লাখ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের তথ্য এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যের চাহিদা থাকলে দ্রুত লাইন-শিফট বাড়িয়ে জোগান বাড়ানোর রেকর্ড বাংলাদেশের আছে। পাশাপাশি ডিজিটাল ম্যাপিং অনুসারে দেশের কারখানার মধ্যে মাত্র দুই হাজার ৭২০টি বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত; অন্যরা সদস্যভুক্তির না হওয়ায় সরবরাহ শৃঙ্খলায় স্বচ্ছতার প্রশ্ন ওঠে।

২০২৪-২৫ জুড়ে গ্যাস প্রেসার কমে যাওয়ায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের রিপোর্টে শিল্প উৎপাদন ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার অভিযোগ এসেছে, ফলে ব্যাকআপ জেনারেশনে ডিজেল ও এলপিজি ব্যবহারে খরচ বেড়েছে। এনার্জি রিলায়েবিলিটি কমলে লিডটাইম রিস্ক বাড়ে, যা শুল্ক-পরবর্তী উচ্চ-খরচ এনভায়রনমেন্টে বায়ারদের জন্য ‘ডাবল হিট’। ফলে নিশ্চিত ক্রয়ের আদেশ থাকা সত্তে¡ও সময়মতো শিপ না করতে পারলে জরিমানা বা ক্রয় আদেশ বাতিলের ঝুঁকি থেকে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘ দিনের পণ্য রফতানি পণ্যের খালাস ও লোডে বিলম্ব হতো। ২০২৫ সালে সরকার এই সময় তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়ে এনেছে, ফলে পণ্যের খালাস ও লোডে অনেক উন্নতি দেখা যাচ্ছে, তবে স্থিতিশীলতা জরুরি।

বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বিজিএমইএ’র তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি ছিল সাড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে; কিন্তু একই সাথে ২০২৪ সালে জগএ ভ্যালু ৩৮ বিলিয়ন থেকে ৩৬ বিলিয়নে নেমেছে, যা মূলত চাহিদা, মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির সমন্বিত প্রতিফলন। ২০২৫-এ ফিরে ‘মডেস্ট রিকভারি’ দেখা গেলেও, নতুন শুল্ক-রেজিম দীর্ঘস্থায়ী হলে সেই রিকভারি টেস্টের মুখে পড়বে। দ্রুত স্কেল-আপ করতে পারা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, তবে এখনকার এনার্জি-লজিস্টিক্স চ্যালেঞ্জ ও ওয়ার্কিং-ক্যাপিটাল খরচ স্কেল-আপে অন্যতম বাধা। তবু বাস্তব চিত্র হলো- ভারতের ৫০ শতাংশ শুল্কের ফলে যদি সে দেশের ক্রয়াদেশ পরিবর্তন করে ভিন্ন কোনো দেশে দেয় এবং বাংলাদেশ যদি তার একটি অংশগ্রহণে সক্ষম হয় সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বাড়তি ক্রয়াদেশ পাবে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন রিটেইলাররা শেয়ারহোল্ডার গাইড্যান্সে স্পষ্ট করেছে, শুল্কের কারণে গ্রস মার্জিন ৫০-১০০ বেসিস-পয়েন্ট ক্ষয়ে পড়তে পারে এবং এর একটি অংশ খুচরা মূল্যের ওপর পড়বে। ভারতের ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যারিফে বাংলাদেশের তুলনামূলক শুল্ক-অ্যাডভান্টেজ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ যদি উচ্চ শুল্ক আইটেমের এক্সপোজার কমিয়ে উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্যে নজর দেয় তাহলে সুবিধা পেতে পারে।

কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। শিল্প-এলাকাভিত্তিক ডেডিকেটেড সাবস্টেশন বা মাইক্রোগ্রিড স্থাপন; গ্যাস-প্রেসার মনিটরিং; রুফটপ সোলার এবং স্টোরেজের স্কেল-আপে করছাড় এবং সফট লোনের ব্যবস্থা এবং বিদ্যুতের কম লোডের সময় টাইম ডায়িং-ফিনিশিং করা- ইত্যাদির মাধ্যমে সমাধান করে যেতে পারে। এক দিকে ট্যারিফে খরচ বৃদ্ধি, অন্য দিকে বন্দরে বিলম্বের ফলে মার্জিনে চাপ সৃষ্টি হবে। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পোর্টের কার্যক্রম আধুনিকায়ন করে সার্ভিস ক্ষমতা অপটিমাইজ করা; রাতের শিফটে কাস্টমস-পোর্ট সার্ভিস বাড়ানো এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে শাটল-ট্রেন-স্কিম দ্রুত চালু করতে হবে।

বিশ্ববাজারে তুলার পাশাপাশি কৃত্রিম তন্তু (এমএমএফ) যেমন- পলিয়েস্টার, ভিসকোজ এবং স্প্যানডেক্সের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশে এই ক্যাপাসিটি তুলনামূলক সীমিত, কারণ ফাইবার, ইয়ার্ন, ফ্যাব্রিক, ডায়িং ও প্রিন্টিংয়ে ইনভেস্টমেন্ট গ্যাপ আছে। শুল্কের ক্ষেত্রে ‘ম্যান-মেড’ ক্যাটাগরির গঋঘ প্রায়ই বেশি। সুতরাং প্রোডাক্ট-ইঞ্জিনিয়ারিং করে ‘লোয়ার শুল্ক ব্যাসকেট’-এ শিফট গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রম কমপ্লায়েন্স ডেটাবেস তৈরি করতে হবে। বাজার ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। চট্টগ্রাম কাস্টমসে ‘প্রি-অ্যারাইভাল প্রসেসিং’, ই-ডকুমেন্টেশনের ব্যবস্থা, রাতের শিফটে ম্যানপাওয়ার; গিয়ারলেস ভেসেলে তিন থেকে ছয় দিন বিলম্ব এক থেকে তিন দিনে নামাতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের করছাড় নীতি বাংলাদেশের জন্য এক ‘অপরচুনিটি উইন্ডো’ তৈরি করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট গার্মেন্টস রফতানি ৬০ বিলিয়ন ডলার পেরিয়ে যেতে পারে। অন্যথায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর কাছে পিছিয়ে পড়বে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ তাই মূলত নির্ভর করছে আজকের নীতিনির্ধারণকারীদের দিকনির্দেশনা, দূরদর্শিতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট