বাঁচার লড়াই : টাইফুন, যুদ্ধ আর টাইটানিকের ছায়া

১৯৮৫ সালের সেই টাইফুন ছিল আমাদের জীবনের এক ‘কোবরা’, এক ‘সিসিল’, এক ‘টাইটানিক মুহূর্ত’-যেখানে হার না মানার শিক্ষা নিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম। এ ফিরে আসা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় বিজয়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এসব লড়াই ইতিহাসে স্থান পাওয়া উচিত, পাঠ্যপুস্তকে না হোক অন্তত প্রজন্মান্তরে গল্পে গল্পে ছড়িয়ে পড়া উচিত। কারণ একেকজন নাবিক যখন সাগরের মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবন বাজি রেখে জাহাজের হাল ধরে রাখেন, তখন তার লড়াইটি যুদ্ধের চেয়ে কম নয়।

নয়া দিগন্ত

যুদ্ধজাহাজ মানে অজেয় নয়, প্রকৃতি যখন ভয়ঙ্কর রূপে আঘাত হানে, তখন রণতরীও হয়ে পড়ে নাজুক। এমন এক স্মরণীয় দিন ছিল ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরে, যখন চীন থেকে নতুন কেনা বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ (বানৌজা) ‘নির্ভয়’ দেশে ফেরত আসার পথে দক্ষিণ চীন সাগরে পড়ে ভয়াবহ টাইফুনে। যাদের সমুদ্রযাত্রায় ধারণা নেই, তাদের কাছে টাইফুন শব্দটি হয়তো শুধু আবহাওয়ার খবরে শোনা কোনো দুর্যোগের নাম। কিন্তু যারা সাগরের বুকে বাস্তবের ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের কাছে টাইফুন এক আতঙ্কের নাম। সেটি যদি হয় সাউথ চায়না সির মতো গভীর ও উত্তাল সাগরে, তাহলে সে ঝড়ের আঘাত কল্পনারও বাইরে।

টাইফুন সিসিলের সাথে বানৌজা নির্ভয়ের ৯ ঘণ্টার যুদ্ধ

১৯৮৫ সালের ১২ অক্টোবর ফিলিপাইনের ইলোইলো অঞ্চলের কাছে সিসিল সৃষ্টি হয়। ৭০টি মাছ ধরার জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। ১৪ অক্টোবর শক্তিশালী টাইফুনে রূপ নেয়। ১৬ অক্টোবর ভিয়েতনামের উপক‚লে আঘাত হানে। এতে সেখানে ৭৬৯ জনের প্রাণহানি ঘটে, ১২৮ জন নিখোঁজ এবং প্রায় ২০০ জন আহত হন। এক লাখ ৩০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ৭০ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। এটি সমুদ্রযাত্রায় খুব বিপজ্জনক ছিল। পথে ১৫ অক্টোবর এই টাইফুনের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটবে চীনসাগর পার হওয়ার আগে। ত্বরিত স্বদেশে নৌসদর দফতর ও ক‚টনৈতিক চ্যানেলে চীন সরকারের কাছে জোরালো অনুরোধ পাঠানো হয় যাতে দ্রুত আমাদের জাহাজটি বেইজিংয়ের নিকটস্থ হাইনান-তাও দ্বীপে আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, চীন সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি মিলল না। প্রতিক্রিয়াও জানা গেল না তাদের। কেননা, সামরিক ও কৌশলগত প্রেক্ষাপটে হাইনান-তাও দ্বীপটি চীনের কাছে ভিয়েতনামের পূর্বে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল একটি দ্বীপ। অনন্যোপায় আমরা তখন হাইনান-তাও দ্বীপ এবং ভিয়েতনামের মাঝামাঝি একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজতে লাগলাম, যেখানে অন্তত ঝড়টি না থামা পর্যন্ত কিছুটা অসুবিধা হলেও আশ্রয় নিতে পারব। তখন আমাদের জাহাজে রয়েছেন ৯ নৌকর্মকর্তা, ৪৮ নাবিক এবং ছয়জন চীনা বিশেষজ্ঞ।

বাংলায় প্রবাদ আছে, অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়! ভাগ্য বিরস থাকলে যা হয় আর কী। হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে, নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আগে বেলা ৩টার কিছু সময় পর ভয়াল আক্রোশে আমাদের ৪০০ টনি ছোট্ট জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দানবিক টাইফুন সিসিল-৮৫। দমকা হাওয়াসহ ঝড়ো বাতাসের গতিবেগ এতক্ষণ ছিল ঘণ্টায় ১০০ মাইল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে তা ছুটতে শুরু করল ঘণ্টায় ১১৫ মাইল বেগে। উত্তাল সাগরে আকাশছোঁয়া ঢেউয়ে ছোট্ট জাহাজটি একের পর এক দুলে উঠে। হিংস্রভাবে ঝাঁকুনি দেয়া শুরু করে। একবার ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসে তো, পর মুহূর্তে প্রবল বেগে ধাবিত হয় অতলে। মনে হতে থাকে এই বুঝি হারালাম চিরতরে গভীর অন্ধকারে।

পাহাড়সম ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আতঙ্কে প্রত্যেক নাবিকের হৃদকম্পন জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করে। যে যার মতো দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলেন। অনেকে উঁচু গলায় আজান দিতে লাগলেন। অনেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে জীবনের সব দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। কেউ গলা ছেড়ে কাঁদছিলেন। এমন পরিস্থিতি, কাউকে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ ছিলেন না; সবাই নিজ নিজ যন্ত্রণায় অস্থির।

ভয়াল সাগরের ভয়ঙ্কর প্রলয়রূপ দেখে এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বিরতিহীন টালমাটাল জাহাজের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সহ্য করতে না পেরে ঝটপট বেশ কয়েকজন ব্রিজ ছেড়ে নিচে নেমে গেলেন। একদিকে ইঞ্জিন রুমের সাহসী সদস্যরা অদম্য চেষ্টা চালিয়ে জাহাজের প্রপালশান ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সচল রাখছেন।

জাহাজের কমান্ডিং অফিসার কমান্ডার বদরুল আমিন, চিফ জিআইকে (বোটসোয়াইনমেট) নির্দেশ দিলেন, চিফ কোয়ার্টার মাস্টার (ঝড়ো আবহাওয়ায় স্টিয়ারিং হুইল চালানোর কাজে অভিজ্ঞ) যেন মনোবল না হারান, সেদিকে খেয়াল রাখতে এবং জাহাজের সম্মুখ অংশ (বাও) ঘোরানোর সময় পানি যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। চিফ জিআই নিজেও কোয়ার্টার মাস্টারের (হেলসম্যান-কাণ্ডারি) মনোবল বাড়াতে কমান্ড ব্রিজে অবস্থান নিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে তিনি প্রচণ্ড আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন। বিধ্বংসী ঊর্মিমালার মাঝখানে ক্ষুদ্র জাহাজের খোলা ব্রিজ (জাহাজ চালানোর রুম) থেকে চারপাশের প্রলয়কাণ্ড দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে একটি ঝড়ো হাওয়া এক খাবলা দিয়ে ব্রিজের শামিয়ানা চোখের পলকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। প্রবল রোলিংয়ে ওভারবোর্ড ভেসে যাওয়ার ভয়ে বাকি যারা ছিলেন, সিওসহ তারাও ব্রিজ ছেড়ে বিকেলের মধ্যে একে একে সবাই নিচে কেবিনে/ডেকে/ওয়ার্ড রুমে নেমে গেলেন।

সেই বিপদের মুহূর্তে স্টিয়ারিং হুইল চালানোর মতো কোনো সক্ষম হেলসম্যান (নাবিক) না থাকাতে অসীম সাহসিকতায় এগিয়ে এসে বেসামাল জাহাজের হাল ধরলেন যে মানুষটি, তিনি জাহাজের নির্বাহী শাখার সর্বকনিষ্ঠ অফিসার ২৪ বছর বয়সী সাব-লেফটেন্যান্ট এম আমিনুর রহমান খান (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন)।

ঝড়ের প্রথম থেকে টানা লড়াইয়ের পর সন্ধ্যা ৭টায় ক্ষান্ত দিলেন ক্ষণিকের জন্য। আমার হাতে স্টিয়ারিং তুলে দিলেন। কিছুক্ষণ পর বিশ্রাম নিয়ে ফিরবেন। যদিও আমি একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সঙ্কটকালে বিকল্প না থাকায় আমাকেও হাল ধরতে হলো। ধরলামও!

সে মুহূর্তে ব্রিজে নাবিক টোপাস চন্দ্র শীল আমার একমাত্র সঙ্গী (যে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে জেনেছি)।

চুক্তি অনুযায়ী, ৪০০ টনি ছোট্ট নৌজাহাজ নির্ভয়কে সম্পূর্ণ নিরাপত্তায় সিঙ্গাপুর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল ২০ হাজার টনি চীনা বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি লুফাংয়ের ওপর। ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত ৯টা। অপস রুমে ভিএইচএফ সেটটি বেজে উঠল হঠাৎ।

চীনা জাহাজ লুফাং ভিএইচএফের মাধ্যমে নির্ভয়কে ‘কল’ করছে। কিন্তু আমার স্টিয়ারিং পজিশন থেকে সরে যাওয়ার উপায় নেই। ভিএইচএফ সেটটি ওপেন ব্রিজের নিচের রুমে। কলটি ধরতে পারছিলাম না। সামনে তাকিয়ে ভয়ার্ত নজরে দেখলাম, সাড়া না পেয়ে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে রওনা হচ্ছে লুফাং। কিছু করার নেই; লুফাং বিপরীত দিকে যাওয়ায় নির্ভয়ের সাথে দূরত্ব দ্রুত বাড়ছে। আমি টোপাস শীলকে বললাম, দ্রুত একজন অফিসারকে খবর দিতে যেন এক্ষুণি তিনি লুফাংয়ের সাথে ভিএইচএফ সেটে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তেমন কোনো অফিসার বা নাবিক খুঁজে পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে রিস্ক নিয়ে নাবিক শীলের হাতে স্টিয়ারিং ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত লুফাংয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম। লুফাং নির্দেশ দিলো কোর্স বদলাতে, কারণ সামনের পথ অনিরাপদ। লুফাংয়ের নির্দেশমতো কিয়ৎকাল পর জাহাজ ঘুরিয়ে তার পিছু নিলাম।

ঢেউয়ের উচ্চতা যদি জাহাজের বিমের সমান উঁচু বা তারও বেশি হয়, তখন এমনিতে সেই ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে জাহাজ চালানো দুঃসাধ্য ও কষ্টকর। তার ওপর তখন যদি হঠাৎ করে জাহাজের দিক বদলানোর প্রয়োজন পড়ে, এর বিপদের ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েক শ’ গুণ। এ সময় বেসামাল ঢেউয়ের এক টোকাতে জাহাজ ছিটকে পড়তে পারে, নিমেষে হারিয়ে যেতে পারে সাগরের অতল গহ্বরে। অতি সাবধানতায় আল্লাহর নাম নিয়ে ধীরে ধীরে জাহাজ ঘুরানোর পর লুফ্যাংয়ের পেছনে যাত্রা শুরু করলাম।

জাহাজের ওপরের ছাদশূন্য খোলা ব্রিজ থেকে জাহাজ পরিচালনার কাজটি করতে হচ্ছে। চারদিক থেকে প্রবল বেগে পানির ছাঁট এসে সহস্র খুদে বর্শার মতো সারা শরীরে বিঁধছে। পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ একের পর এক এসে জাহাজের ডেক ভাসিয়ে গড়িয়ে যাওয়ার আগে আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। হিমেল বাতাস আর ভেজা পোশাকে ক্রমে শীতল হয়ে আসছে শরীর। টোপাস শীল বেশ কয়েকবার ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে শুকনো পোশাক এনে দিলেন। কিন্তু কয়েক মুহূর্তে সব ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। অবশেষে শুধু একটি লুঙ্গি কোমরে বেঁধে খালি গায়ে নেমে পড়লাম। কায়মনোবাক্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে কেবল একটি প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাকে আরেকটু শক্তি দেন যাতে শুধু জাহাজ চালানোর কাজটি অন্তত চালিয়ে যেতে পারি।

চারপাশ প্রগাঢ় অন্ধকার, কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমার একমাত্র ভরসা রাডার ডিসপ্লে, লুফাংকে অনুসরণ করে চলেছে। রাত ১০টার সময় সাব-লেফটেন্যান্ট খান বিশ্রাম শেষে ব্রিজে এলেন। আমি কেবিনে গেলাম। সাব-লে: খান একা সেই কঠিন পরিস্থিতিতে স্টিয়ারিং চালিয়ে গেলেন। টানা ৯ ঘণ্টা, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি, জাহাজটি তুফানের সঙ্গে লড়াই করে। ধীরে ধীরে ঝড়টি দুর্বল হতে শুরু করেছে। সকালের দিকে সুবিধাজনক স্থানে নোঙর করলাম। গত রাতের ঝড়ে জাহাজের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। টানা ২০ ঘণ্টা বানৌজা নির্ভয়ের সাথে নৌসদর দফতরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সবাই ধরে নিয়েছেন সলিল সমাধি হয়েছে নির্ভয়ের। নৌসদর দফতরের নির্দেশনায় বাংলাদেশের সব মসজিদে দোয়া করা হয়। যদিও নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের তখনো কিছু জানানো হয়নি। নির্ভয়ের নিখোঁজ থাকার সংবাদটি জানানো হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রধানকেও।

ইতিহাসের প্রতিধ্বনি : টাইফুন কোবরা ও লেফটেন্যান্ট ফোর্ড।

১৯৪৫ সালের ৫ জুন ‘কনি’ নামে টাইফুন প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন তৃতীয় ফ্লিটে আঘাত হানে। এতে ছয়জন প্রাণ হারান। ৩৩টি জাহাজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই বছরের ২৪ অক্টোবর ‘লুইস’ নামে আরেকটি টাইফুন আঘাত হানে। এতে ১২টি মার্কিন জাহাজ সমুদ্রে ডুবে যায়, ২২২টি জাহাজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং দ্বীপের আশপাশের বেশির ভাগ সামরিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। ওই টাইফুনে ৩৬ আমেরিকান নিহত, ১০০ জন গুরুতর আহত এবং ৪৭ জন নিখোঁজ হন। টাইফুন কোবরা ছিল আমেরিকার যুদ্ধজাহাজের মৃত্যুর দিন।

প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত মার্কিন নৌবহরে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৪ আঘাত হানে। এতে তিনটি ডেস্ট্রয়ার (ইউএসএস স্পেন্স, হাল এবং মোনাঘান)) ডুবে যায়, ৯টি জাহাজের এবং এয়ারক্রাফট ক্যরিয়ারের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাণ হারান ৭৯০ জন নাবিক। এ ছাড়া ১৪৬টি বিমান ধ্বংস হয়। ২৭টি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ১১টির ব্যাপক মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। নৌবাহিনী এ ঘটনাকে ‘অদৃশ্য শত্রুর হাতে পরাজয়’ বলে বর্ণনা করে। এ বহরের একটি জাহাজ ছিল টঝঝ গড়হঃবৎবু এখানে কর্তব্যরত ছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট জেরাল্ড ফোর্ড, যিনি পরে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট হন। ঝড়ের সময় বিমানের ইঞ্জিন থেকে আগুন লেগে যায় হ্যাঙ্গার ডেকে। ফোর্ড নিজে স্লিপ করে পড়ে যান, কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে যান। পরিস্থিতি সামাল দিতে সফল হন। ফোর্ডের নেতৃত্ব- বিশেষ করে আহতদের সরিয়ে নেয়া এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করায় জাহাজটি বাঁচিয়ে রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে তিনি একে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক মুহূর্তগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। এ অসাধারণ সাহসিকতা, ধৈর্য ও নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ, মার্কিন নৌবাহিনী পরবর্তীতে একটি পরমাণু চালিত বিমানবাহী রণতরীর নামকরণ করে তার নামে- টঝঝ এবৎধষফ জ. ঋড়ৎফ (ঈঠঘ-৭৮)। এটি আজ মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলোর একটি।

যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, প্রকৃতির বিরুদ্ধেও যে একজন সেনা তার নৈপুণ্য ও সাহসিকতার প্রমাণ দিতে পারেন, তার জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন ফোর্ড। ওপরে বর্ণিত এ তিন ঝড়ের তাণ্ডবই প্রমাণ করে : যুদ্ধের ধ্বংস নয়, প্রকৃতির আঘাত ষড়যন্ত্রের তুলনায় অনেক বিধ্বংসী। অ্যাডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসির নেতৃত্বাধীন মার্কিন রণতরীগুলো এদিন হার মানে প্রকৃতির কাছে। টাইফুন কোবরা প্রমাণ করে- সমুদ্র যুদ্ধে প্রকৃতি সব থেকে শক্তিশালী শত্রু।

টাইটানিক : প্রযুক্তির অহঙ্কারের পতন

আরেকটি ইতিহাস- ১৯১২ সালের এপ্রিলের সেই আলোচিত রাত। ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ টাইটানিক, যাকে বলা হতো ‘সাগরে শোলা ডুববে কিন্তু টাইটানিক ডুববে না’ এ রকম একটি কথা নাকি টাইটানিকের প্রস্তুতকারক বলেছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তি, বিলাসবহুল ডিজাইন- সব ব্যর্থ হয় প্রকৃতির এক খণ্ড বরফের আঘাতে। ১৫০০ জনের মৃত্যু হয় সে রাতে। এ গল্প আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি যত আধুনিক হোক না কেন, প্রকৃতি আর সমুদ্রের সামনে সব ক্ষুদ্র। সে কারণে নাবিকদের সাহস, দূরদৃষ্টি এবং মানসিক প্রস্তুতি একমাত্র রক্ষাকবচ।

‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ মনোবল ও ঈমান

অনেকে মনে করেন, নৌবাহিনী শুধু যুদ্ধে নিয়োজিত। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- প্রকৃতির সাথেও লড়াই করেন নৌসেনারা। সে যুদ্ধেও থাকে মৃত্যু, বীরত্ব, কৌশল ও নেতৃত্বের পরীক্ষা। যেমনটি হয়েছিল ১৯৮৫ সালে আমাদের বানৌজা নির্ভয়ের সঙ্গে। সেদিন আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল না- ছিল কেবল স্টিয়ারিং হুইল, আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা এবং আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস। শুধু আল্লাহর কৃপায় যখন মানুষের দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতা নেতৃত্বে থাকে, তখন তীব্রতম ঝড়ও যেন নতজানু হতে বাধ্য হয়।

প্রাপ্তির মুহূর্ত : স্টিয়ারিং হুইল ফিরে পাওয়া

সঙ্কটময় মুহর্তে স্টিয়ারিং করতে পরবর্তীতে নৌবাহিনীর প্রধান আমাকে প্রশংসাপত্র (খবঃঃবৎ ড়ভ ঈড়সসবহফধঃরড়হ) দেন। আরো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে বহু বছর পর, ২০২২ সালে বানৌজা নির্ভয় যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ডিকমিশন (উবপড়সসরংংরড়হ) করা হয়, তখন নৌবাহিনী প্রধান আমাকে জাহাজের সেই অরিজিনাল স্টিয়ারিং হুইলটি তুলে দেন- যেটি ১৯৮৫ সালের সেই বিভীষিকাময় সময়ে স্টিয়ারিং করেছিলাম। সেই হুইল এখন শুধু একটি ধাতব বস্তু নয়; বরং একটি ইতিহাসের অংশ- সাহস, কৌশল এবং নৌসেনার প্রকৃত শক্তির নিঃশব্দ প্রতীক।

উপসংহার : যে ইতিহাস মুখে বলা হয় না, তাও ইতিহাস। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার গল্প পুরো বিশ্ব জানে। ‘কাবরা’, ‘কনি’ ও ‘লুইস’ টাইফুনের কথা মার্কিন ইতিহাসে লেখা হয়েছে। কিন্তু টাইফুন সিসিল ও বিএনএস নির্ভয়ের সে লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা জানি না, লিখিও না। অথচ সেটিও এক মস্ত লড়াই- বেঁচে থাকার লড়াই, দেশের পতাকা ধরে রাখার লড়াই।

১৯৮৫ সালের সেই টাইফুন ছিল আমাদের জীবনের এক ‘কোবরা’, এক ‘সিসিল’, এক ‘টাইটানিক মুহূর্ত’-যেখানে হার না মানার শিক্ষা নিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম। এ ফিরে আসা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় বিজয়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এসব লড়াই ইতিহাসে স্থান পাওয়া উচিত, পাঠ্যপুস্তকে না হোক অন্তত প্রজন্মান্তরে গল্পে গল্পে ছড়িয়ে পড়া উচিত। কারণ একেকজন নাবিক যখন সাগরের মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবন বাজি রেখে জাহাজের হাল ধরে রাখেন, তখন তার লড়াইটি যুদ্ধের চেয়ে কম নয়।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপউপাচার্য, বিইউপি