প্লেটো অমরাবতীতে অবকাশ যাপনের সময় কৌটিল্য বা চাণক্য পণ্ডিতের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পান। কী ব্যাপার? কৌটিল্য লিখেছেন- আমার ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং আপনার ‘রিপাবলিক’ চর্চা ও অনুসরণে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে মর্ত্যরে চুয়ান্ন বছর বয়সী এক দেশ। সত্বর এটি নিয়ে অমর্ত্যলোকে অন্তত ছোট একটি ওয়ার্কশপ করা যায় কি না যেখানে জুলাই সনদকে সে দেশের সংবিধানের অংশ কিভাবে করা যায় অর্থাৎ- এর আইনগত ভিত্তি দেয়া যায় তার সুরাহা সন্ধান ও সুপারিশ করা হবে। কেননা, এটা নেয়া নিয়ে সেখানে রাজনৈতিক যে ক্যাচাল শুরু হয়েছে তার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিরপেক্ষ রিভিউ হওয়া দরকার।
প্লেটো বয়সে কৌটিল্যের চেয়ে ৫২ বছরের বড়। প্লেটো এথেন্সের আর চাণক্য পণ্ডিত ভারতের হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ শক্ত ভিত্তির ওপর। প্লেটো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কৌটিল্যকে রিপ্লাই করলেন এভাবে-
প্রিয় পণ্ডিত! শুভেচ্ছা নিও। তোমার উত্থাপিত বিষয়টি বেশ চমৎকার। আমিও যে ক’দিন ধরে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছিলাম না তা নয়। সে দিন সন্ধ্যায় আমার শিষ্য অ্যারিস্টটল আমাকে বলছিল, ‘ওস্তাদ এমন অদ্ভুত দেশের কথা আগে শুনিনি। আমাদের আলেকজান্ডার অবশ্য তার সাগরেদ সেলুকাসকে বলেছিল- কী বিচিত্র এই দেশটির কথা। আমাদের পাড়ায় থাকেন গীতিকবি ও আমলা দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, তিনি নাকি তার গানে এটিও লিখে এসেছেন- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ তোমাদের ডিএল রায়ের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, এ ধরনের দ্ব্যর্থবোধক বাক্য তিনি কেন লিখেছিলেন। তিনি শুধু মুচকি হাসি দিলেন। যাই হোক, আমি তোমার উদ্বেগকে স্বাগত জানাই। তবে তোমার প্রস্তাবমতো ওয়ার্কশপ করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। আইডল ব্রেন ইজ ডেভিলস ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপগুলো প্রায়ই ডেভিলস বা শয়তানের আড্ডাখানায় পরিণত হয়। কেননা, জনাকয়েক আঁতেল প্রজাতির কিংবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবী অলস সময় কাটাতে একসাথে বসে লাঞ্চ খাওয়া ও পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো কথা না বলে অনেক কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেটে পড়ে। এরা সকালে সুকান্ত-বিকেলে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যায়। সে দেশের বর্তমান অনেক মিডিয়া, আমলা, আইনের লোক, চিন্তাচৌবাচ্চার কেউ কেউ আসলে পতিত সরকারেরই পক্ষের হয়ে কাজ করছে। তারা তাদের ক্যামেরা ও কলমে ছাত্র-জনতার অনুরোধে গঠিত মধ্যবর্তী সরকারকে বেসামাল করে দিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরির দোষ তাদের ওপরেই চাপাচ্ছে। পণ্ডিত, তুমি দেখছ নিশ্চয়ই ওই দেশের ঐকমত্যতার আবহকে ‘ঐক্য চূর্ণ, ভোটের কী হবে’ এ ধরনের সংবাদ শিরোনাম দিয়ে কিভাবে দল ও মতের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েই চলেছে। সমন্বয় সমঝোতাদের সেখানে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ জাতীয় বডি ল্যাঙ্গুয়েজে প্রকাশ পাচ্ছে। তবে তুমি তো জানো, এটি নতুন নয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রদানকল্পে লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকগুলো থেকে ডজনখানেক মিশন ও কমিশনের কসরতে শেষ পর্যন্ত পরস্পর কলহে লিপ্ত দু’টি দেশ হলো। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে উইনস্টন চার্চিল সাহেবের ভূমিকা এখন এমনভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে যে, তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া ঠিক হয়নি বলে মতামত, মন্তব্য মিলছে। নোবেল পুরস্কারের কথা এবং এর হবু প্রাপকদের মধ্যে রঙ্গব্যঙ্গ নিয়ে আজ কোনো মন্তব্য না করি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধানো এবং মিটমাটের নামে উভয়কে ধমক দিয়ে যুদ্ধবিরতির রেকর্ড পরিসংখ্যানেও কুলাচ্ছে না। কারো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য সাজানো শরণার্থী নাটক এখনো মঞ্চস্থ হচ্ছে।’
প্লেটোর এ মেসেজের জবাবে কৌটিল্য লিখলেন- ‘এখন যুক্তির কথায় আসা যাক ওস্তাদ। দেশটিতে সংবিধান এবং সনদ নিয়ে বর্তমানে যে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি চলছে তার একটি গতিপথ সন্ধান এবং কিভাবে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে সে ব্যাপারে আমরা এই অমর্ত্যলোক থেকে কিছু একটা করতে অগ্রসর হতে পারি কি না। আপনি এবং আমি দু’জন এভাবে মেসেজ চালাচালি করে সমস্যার প্রতি সুবিচার করতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। ওয়ার্কশপ না হোক নিদেনপক্ষে একটি ওয়েবিনার সেমিনার, তা না হলে অন্তত গোলটেবিল বা গ্রুপ ফোনালাপ হতে পারে -ইতি আপনারই কৌটিল্য।’ প্লেটোর প্রতিক্রিয়া- ‘পণ্ডিত! তোমার কথা ঠিক, এ বিষয়ে অমর্ত্যলোক থেকে তুমি আমি ছাড়া সংবিধান বিশেষজ্ঞ, প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক, আর্থ প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ এবং ঝানু রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি ঘরোয়া গোলটেবিল বৈঠক করলে কেমন হয়। লিমিটেড অংশগ্রহণকারী দরকার। আঁতেল বুদ্ধিজীবী, কবি লেখক সাহিত্যিক ও আইনজ্ঞ, ঝানু পলিটিশিয়ানদের এভাবে জড়ো করতে ডেকে আনার দরকার নেই। তারা শুধু প্যাঁচাবে, তুমি প্রস্তাব করো- যাদেরকে আমরা আহ্বান জানাতে পারি তাদের যোগ দিতে। প্রতিনিধিরা যেন মুখ্য তিন অঞ্চল বা শক্তির বলয় থেকে আসেন- তিন অঞ্চল বলতে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ গোলার্ধ বুঝাবে, আর শক্তি বলয় বলতে মার্কিন, রাশিয়া ও চীন। শেষমেশ প্লেটো ও পণ্ডিত একমত হলেন, গোলটেবিল বৈঠকে বড়জোর পাঁচ প্রাজ্ঞজন অভিমত রাখবেন, আলোচনা-পর্যালোচনা সারবেন। তবে এই পাঁচ প্রাজ্ঞজন প্রাথমিকভাবে সে দেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও গণতন্ত্র চর্চা সম্পর্কে পরলোকে আসা বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলের সাথে পরামর্শ করতে পারবেন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইসতিয়াক আহমেদ, বদরুদ্দীন উমর, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমদ প্রমুখ।
চাণক্য পণ্ডিতের মত হলো- ৫৪ বছর বয়সী দেশটিতে বারবার গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ ঘটলেও তা টেকসই রূপ পরিগ্রহ করতে সময় নিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে যারা পরলোকে এসেছেন তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু কালের কপোলতলে ঘটনাপ্রবাহে টেকসই কোনো প্রবণতা সম্পর্কে তারা স্পর্শকাতরতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন না। দেশটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সেখানে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পেক্ষাপটে বাইরের ছোবল বাড়ছেই। সেখানে আত্মমর্যাদায় সিক্ত হয়ে স্বয়ম্ভর-স্বনির্ভর রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা স্বাধীনভাবে গড়ে উঠতে পারছে না। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সারথিদের মধ্যে ইতোমধ্যে ঐক্যবদ্ধতা ও দৃঢ়চিত্ততায় কিছুটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিপ্লবের সাথে স্বাভাবিক চিন্তাচেতনার, বৈপ্লবিক ভাবভাবনার সাথে অতি স্বাভাবিক আচা-আচরণের মিথস্ক্রিয়া সংস্থিত হয়নি। কয়েক বছর আগে কায়রোর তাহির স্কয়ারের বিপ্লবের যে পরিণতি, কখনো সখনো মনে হচ্ছে আলোটা সে দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সম্প্রতি দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় গণজাগরণ-উত্তর পরিবেশে সে দেশ ও অর্থনীতি খাদের কিনারে চলে যাওয়া থেকে শ্রীলঙ্কা যে কারণে পরিত্রাণ লাভ করছে, এ দেশের আন্দোলন-উত্তর পরিবেশে সংহতির দিকে না গিয়ে নানা মুনির নানা পথ মাড়াবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। আশঙ্কা এই যে, ঐক্যে ফাটল ধরলে ঘটনা যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে, তাতে আম-ছালা দুটোই যাওয়ার জোগাড় হতে পারে।
প্লেটোর পৌরাহিত্যে গোলটেবিল বৈঠকে অ্যারিস্টটল, অ্যাডাম স্মিথ, আলেকজান্ডার এবং চাণক্য পণ্ডিত অংশগ্রহণ করলেন। সূচনা বক্তব্য কৌটিল্যই দিলেন, ৫৪ বছর বয়সী দেশটার সাম্প্রতিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও ঐক্য-অনৈক্য নিয়ে যে জটিলতা তা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় বাতলে দিতে এই বৈঠক। সবার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য ও ব্যাখ্যা শোনার পর প্লেটো আহŸান-সংবলিত সারমর্ম পেশ করলেন, জুলাইয়ের সনদকে আইনগত স্বীকৃতি অর্থাৎ- একে সংবিধানের অংশ করা সমীচীন হবে, নতুবা জুলাইয়ের আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় শুধু বিমর্ষ বিমলিনই হবে না, প্রকারান্তরে জুলাই যোদ্ধারা, এমনকি মধ্যবর্তী সরকার নিজেরা এবং তাদের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেটি হবে মর্মান্তিক এবং ভবিষ্যতে স্বৈরাচার কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আগ্রহ হারাবে মানুষ। সবাই সর্বসম্মতভাবে এ ব্যাপারে রাজি না হলে সনদকে সংবিধানের অংশ করার কাজে বা উদ্দেশ্যে গণভোট একটি সংবিধানসম্মত পন্থা হতে পারে। তবে সেটি জাতীয় নির্বাচনের সাথে, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের এক আয়োজন, এক অর্থ ব্যয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা গেলে অনেকগুলো পোলারাইজেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব হবে। গণভোট এবং স্থানীয় সরকার ভোট আলাদাভাবে করতে গেলে নানাবিধ বিপত্তির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। জুলাই অভ্যুত্থানের আইনগত স্বীকৃতির নিশ্চয়তা নিশ্চিত হলে জাতীয় নির্বাচন নির্ভার ও উৎসবমুখর পরিবেশ পাবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচ্যুতির বিবরে না নিয়ে স্বচ্ছ ও সাবলীল করতে পারলে স্ববিরোধী সমস্যা রানআউট করিয়ে সাজঘরে পাঠানো সহজ হবে। সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় স্বপ্রণোদিত জনগণকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। ডিম আগে না মুরগি আগে- এ তর্কে এভাবে প্রবৃত্ত হওয়ার সময় এটি নয়, সময় হলো ডিম ও মুরগি উভয়ের সাথে সমঝোতার। যিনি ‘যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমতাচ্যুত করেন... যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন। যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন, রাতকে বড় করে দিনকে ছোট করেন, আবার দিনকে বড় করে রাতকে ছোট করেন, প্রাণহীনকে প্রাণ দান করেন, আর প্রাণবন্তকে প্রাণহীন করেন’ সেই প্রভু নিরঞ্জনই সহায় হবেন সেই জাতির, যারা নিজেরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে আন্তরিক ও একাগ্র।
লেখক : অনুচিন্তক



