বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণ করা ছিল তাদের পক্ষের প্রতিরক্ষা আইনজীবীদের প্রধান কৌশলগুলোর একটি। এ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, যিনি প্রধান প্রতিরক্ষা আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিয়মিতভাবে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী দূতাবাসগুলোকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করতেন। যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে দেশটির পররাষ্ট্র দফতর ও গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস অফিস এ বিচার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করত এবং নিয়মিত তথ্য নিত। ব্রিটিশ ফরেন অফিসকেও বিষয়টি জানানো হয়েছিল, যদিও তাদের সক্রিয়তা তুলনামূলকভাবে কম লক্ষ করা গেছে। জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথেও জনাব রাজ্জাক সাক্ষাৎ করতেন, যাতে বিশ্ববাসী বুঝতে পারেন- বিচারগুলো প্রকৃত ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে নয়; বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
প্রতিরক্ষাদলের প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। বিদেশী কূটনীতিকরা বিচারপ্রক্রিয়ার ন্যায্যতা সম্পর্কে মন্ত্রীদের কাছে জটিল প্রশ্ন করতে শুরু করেন। আদালতে ও জনসমক্ষে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সক্রিয় অবস্থান সরকারের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দেয়। তাকে পুলিশি নজরদারির আওতায় আনা হয়। অবশেষে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর দেশত্যাগে বাধ্য হন, যখন তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পারেন, তাকে গ্রেফতার করা হতে যাচ্ছে। আমি যখন একটি পশ্চিমা দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করি, সরকার কেন তাকে গ্রেফতার করতে চাচ্ছিল, তিনি বলেন- ‘কারণ আদালতে এবং বিদেশী মিশনের সাথে তার কাজ সরকারকে বিব্রত করছিল, দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরেও।’
কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে জনাব রাজ্জাকের সাথে সরকারের উপদেষ্টা ও বিদেশী কূটনীতিকদের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো সরাসরি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হচ্ছিল। জানা যায়, এ বিষয়ে তিনি ভারতের পরামর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে সবসময় ভারতের নির্দেশনা মেনে চলতেন না তিনি। উদাহরণস্বরূপ- তিনি আপিল বিভাগকে বাধা দেন, যাতে ট্রাইব্যুনালের দেয়া আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল না রাখেন। যদিও তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দৃঢ়ভাবে আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পক্ষে ছিলেন, শেখ হাসিনা তা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর যে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, তা শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রতিটি নির্দেশনা অন্ধভাবে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সতর্ক করে তোলে।
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালগুলোর বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর দেশজুড়ে যে তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে, তা সরকারকে তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়নের দিকে ধাবিত করে। ৮ জুন ব্যারিস্টার রাজ্জাক প্রতিরক্ষাদলকে জানান, শেখ হাসিনার দুই উপদেষ্টা- সালমান এফ রহমান ও গওহর রিজভী কূটনৈতিক সূত্রে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন, কিভাবে জামায়াতকে শান্ত রাখা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে। এতে স্পষ্ট হয়, তারা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দায়িত্বটি পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশনের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সাথে সালমান এফ রহমান ও গওহর রিজভীর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে গওহর রিজভী জনাব রাজ্জাককে জানান, আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে বিএনপির সাথে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তিনি জামায়াতকে পরামর্শ দেন, যেন তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আন্দোলন বন্ধ করে বিএনপির মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার রাজ্জাক জনাব রিজভীকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের কারণে জামায়াতের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুরুতে গওহর রিজভী দাবি করেন, ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করছে। তবে দাবিটি তিনি যথার্থ যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করতে পরেননি, হয়তো তিনি নিজেও তা গুরুত্ব-সহকারে বলেননি। কারণ ২০১৩ সাল নাগাদ স্পষ্ট হয়ে যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালগুলো শেখ হাসিনার নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছিল। জনাব রাজ্জাক তাকে জানান, ট্রাইব্যুনালগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। তখন গওহর রিজভী কিছুটা নমনীয় হয়ে বলেন, মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলেও জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে না, যদি জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেয়। এ থেকে স্পষ্ট হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কখনো প্রকৃত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গঠিত হয়নি। সেগুলো ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার, যা দরকষাকষির মাধ্যমে বিরোধীদের চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০১৩ সালের ২ জুলাই ব্যারিস্টার রাজ্জাক যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশনের সাথে এক ব্রেকফাস্ট মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ডেপুটি চিফ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে জানান, সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তার সাথে দেখা করতে আগ্রহী। ডেপুটি চিফ অব মিশনের মতে, আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের পর যে তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে তা প্রথমবারের মতো সরকারকে অস্থির করে তোলে। মন্ত্রীরা ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওই দিন পরবর্তী সময়ে জামায়াতের যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান জনাব রাজ্জাককে ফোন করে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নিজস্ব মূল্যায়নে বলা হয়েছে- শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে জালিয়াতি করলে কেবল ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন।
২০১৩ সালের ১৪ জুলাই ব্যারিস্টার রাজ্জাক ফরাসি দূতাবাসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গওহর রিজভীর সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করেন। সেখানে জনাব রিজভী তাকে জানান, পরবর্তী দিন ঘোষিত হতে যাওয়া অধ্যাপক গোলাম আযমের রায় নিয়ে জামায়াত ‘সন্তুষ্ট’ হবে। এর অর্থ ছিল এই যে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না। পরদিন, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাপক গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এ রায় শেখ হাসিনার নির্দেশে দেয়া হয়। তবে ট্রাইব্যুনাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ওই কারণে রায়ে উল্লেখ করা হয়, অধ্যাপক আযমের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হলেও, তার বয়স বিবেচনায় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আবারো দেখা গেল, সরকারের ওই উপদেষ্টা রায় ঘোষিত হওয়ার আগে রায়ের বিষয়টি জানতেন, যা প্রমাণ করে, ট্রাইব্যুনাল নয়, রায় নির্ধারণ করেছিল সরকার।
২০১৩ সালের ৯ আগস্ট, ঈদের দিনে আব্দুর রাজ্জাক প্রধান বিচারপতির বাসভবনে বিচারপতি ওয়াহাব মিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া জানান, আপিল বিভাগের বিচারকরা আব্দুল কাদের মোল্লার আপিলের রায় আগস্ট মাসের মধ্যে ঘোষণার জন্য তীব্র চাপে রয়েছেন। তিনি আরো জানান, ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট আপিল বিভাগ এ বিষয়ে আলোচনা করতে বসবেন। সেই সময় আপিল বিভাগে বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া ছিলেন একমাত্র সাহসী বিচারক, যিনি চাপের মুখেও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তর করেন। আপিল বিভাগের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এটিই ছিল প্রথম। বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া এই সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন।
২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মৌখিকভাবে রায় ঘোষণা করা হলেও বিচারকদের রায় লিখতে কিছু সময় লেগেছিল। বিচারপতি ওয়াহাব মিয়ার ওপর তার ভিন্নমতপূর্ণ রায় দ্রুত লিখে শেষ করার জন্য তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রায় স্বাক্ষরিত হয় এবং তা ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়।
২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ব্যারিস্টার রাজ্জাককে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- পরবর্তী নির্বাচনের আগে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এ বিষয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না। এরপর ১২ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ওই ফাঁসি ঠেকাতে কূটনৈতিক মহল নানা উদ্যোগ নেয়- সরকারের সদস্যদের সাথে বৈঠক, আলোচনার আয়োজন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও সরকারকে অনুরোধ করেন যেন ফাঁসি কার্যকর না করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার ওপর ভারতের প্রভাব এতটা তীব্র ছিল যে, এসব আন্তর্জাতিক অনুরোধ কার্যকর হয়নি।
এ অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দেয় যে, যখন ন্যায়বিচার হুমকিতে পড়ে, তখন আইনজীবী ও নাগরিক সমাজকে আদালতের গণ্ডির বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া শুধু প্রয়োজনীয় নয়; বরং এটি সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার ও আইনের শাসন রক্ষার একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে। যদিও ব্যারিস্টার রাজ্জাকের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে পারেনি, তথাপি সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে যেসব স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি।